গল্প শোনার প্রতি সবারই একটা বিশেষ ভালোলাগা কাজ করে; হোক সেটা নিজে বই পড়ে, নানী-দাদীর কাছ থেকে গল্প শুনে কিংবা ইউটিউবে অডিওবুক স্ট্রিমিং করে। আর যদি সেটা হয় রোমাঞ্চকর রহস্য ও ভৌতিক গল্প, তাহলে তো কথাই নেই। একদা এক ব্রাক্ষণ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো অথবা পোড়োবাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথে তার পেছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেলো; কথাগুলো দূর থেকে শুনতে পেলেও অবচেতন মনেই যেন সবাই কান পেতে থাকে পরে কি ঘটছে তা শোনার জন্য। এখন হয়ত আর সেই গল্পদাদু নেই, কিন্তু রোমাঞ্চকর রহস্য ও ভৌতিক গল্প শোনার জন্য আছে দারুণ কিছু বাংলা ইউটিউব চ্যানেল। তেমনি কয়েকটি চ্যানেলের ব্যাপারে জানা যাবে আজকের ফিচারে।
রহস্য ও ভৌতিক গল্প শোনার সেরা ১০টি বাংলা ইউটিউব চ্যানেল
থ্রিলার ল্যান্ড
২০২০ সালের ১৫ মার্চ থ্রিলার, হরর, ফ্যান্টাসি ও সাসপেন্স গল্পের ওপর ফোকাস করে খোলা হয় এই ইউটিউব চ্যানেলটি। ভারতীয় কতক গল্পবলিয়েদের কন্ঠের মাধুর্যে গত দুই বছরে চ্যানেলটির সংগ্রহ হয় ৮ লাখ ৪৯ হাজার গ্রাহক। কমেন্ট বক্স জুড়ে দর্শক মুখরতা স্থির চিত্রের নেপথ্যের কথাগুলোর আবেশের কথা জানান দিয়ে যায়। থ্রিলার ল্যান্ডে এ পর্যন্ত মোট ১১৭টি ভিডিও বানানো হয়েছে, যেগুলোতে পাওয়া সর্বমোট ভিউ সংখ্যা ৬৪ লাখেরও বেশি।
এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পাওয়া অডিওবুকটি হচ্ছে মহুয়াডহর মায়া শিরোনামের ভিডিওটি। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি করে গল্প বলা প্রকাশ করা হয়ে থাকে চ্যানেলটিতে। বাংলা রহস্য ও ভৌতিক গল্পের চ্যানেলের দিক থেকে থ্রিলার ল্যান্ড শীর্ষস্থানীয় একটি ইউটিউব চ্যানেল।
আরও পড়ুন: ঈদুল আযহার বাংলা সিনেমা ২০২২: সিনেমাপ্রেমিদের ঈদ আনন্দ
ভেল অব টেল্স
বিশ্বসাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ধারাকে ফিচার করা হলেও এই চ্যানেলের গল্পগুলোর মধ্যে রহস্যের উপস্থিতিটা বেশি পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় কয়েকজন গল্পকথক নামকরা সাহিত্যগুলোর পাশাপাশি নিজেদের কন্ঠে নিয়ে আসে নিজেদেরই রচিত কিছু গল্প। সর্বমোট ৮৫টি ভিডিওর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাহিনীগুলো বিদেশি গল্প থেকে অনূদিত, যার কাজটি করেন চ্যানেলের পরিচালকরাই।
২০১৯ এর ২৯ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ভেল অব টেল্সের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫ লাখ ৯ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে ৪১ লাখের বেশি বার দেখা ভিডিওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ পেয়েছে শার্লক হোমসের সিংহের মানি গল্পটি। গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে থ্রিলার ল্যান্ড-এর পরেই রাখা যেতে পারে এই চ্যানেলটিকে।
স্ক্যাটার্ড থটস
বিশ্ব বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্প শুনতে হলে স্ট্রিমিং করতে হবে স্ক্যাটার্ড থটসের ভিডিওগুলো। রোমহর্ষক পোস্টার আর কন্ঠের নাটকীয়তায় পুরো ভিডিওটি যে আসলে স্থির চিত্রের, তা বেমালুম ভুলে বসতে হবে। ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে কয়েকজন ভারতীয় তরুণ-তরুণী তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় প্রতিনিয়ত চ্যানেলটির গুণাগুণ বাড়িয়ে চলেছেন।
তার ফসল আজ অবধি চ্যানেলটির সংগৃহীত ১ লাখের বেশি গ্রাহক এবং ১২৭টি ভিডিওতে ৯৩ লাখের বেশি ভিউ। সহজ বাংলা ভাষায় যখন রহস্যের জটগুলো খুলতে শুরু করবে, সে মুহুর্তের চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার মত অমূল্য আর কিছু হয় না। এখন পর্যন্ত চ্যানেলটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বার যে ভিডিও দেখা হয়েছে তার শিরোনাম হলো শার্লক হোমসের ব্রুস পার্টিংটন প্ল্যানের অ্যাডভেঞ্চার।
আরও পড়ুন: নিউইয়র্কে প্রথম ইংরেজি মঞ্চ নাটকে তাসনুভা আনান
থ্রিলার স্টেশন
থ্রিলার ল্যান্ডের কয়েক মাস আগে ২০১৯-এর ৩১ অক্টোবর এই ইউটিউব চ্যানেলটি প্রতিষ্ঠা করা হলেও এখন পর্যন্ত এর অর্জিত গ্রাহকের সংখ্যা ১ লাখের বেশি। চ্যানেল টাইটেল প্রায় একই রকম হলেও কিন্তু ভারতীয় বাংলা চ্যানেল দুটোর নির্মাতারা এক নন। অবশ্য দুটোরই ইউটিউব কন্টেন্টের মুল বিষয়বস্তু এক- থ্রিলার, গোয়েন্দা ও রহস্য গল্প।
চ্যানেলটির বর্তমান ভিডিও সংখ্যা মোট ৪৭টি এবং তাতে সর্বমোট ভিউ সংখ্যা ৬৩ লাখের বেশি। গল্পকথকরা এখানে সব সময় স্থির চিত্রের আড়ালে থাকেন না। মাঝে মাঝে স্টুডিওতে রেকর্ড করা অবস্থাতে তাদের পুরো গল্প বলাটাও দেখানো হয়। ভিডিওগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ভালো লাগা কন্টেন্টটির নাম ‘রাত নামলেই’।
গল্পের ফেরিওলা
রাজদ্বীপ চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল ও তাদের কিছু বন্ধুরা মিলে গল্পের ফেরিওলার নাম। ২০২০-এর ৪ এপ্রিল থেকেই তিনি তার অসাধারণ গল্প বলার নৈপুণ্য দিয়ে অতি যত্নে গড়ে তুলেছেন গল্প ফেরিওলা ইউটিউব চ্যানেলটি। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন জনরাতে পরিভ্রমণ হলেও রাজদ্বীপ ইউটিউবার মূলত রহস্য ও হরর কন্টেন্টের জন্য বিখ্যাত।
এখন পর্যন্ত ভারতীয় বাংলা চ্যানেলটির অর্জন ১ লা্খেরও বেশি গ্রাহক। সর্বমোট ১২১টি ভিডিওতে ১০ লাখের বেশি ভিউ পাওয়া চ্যানেলটি এখনো গ্রাহকদের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পাওয়া ভিডিও হলো ‘সাবাশ ফেলুদা’। প্রাসঙ্গিক স্থির চিত্রের পাশাপাশি এর ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যানিমেশনগুলোও বেশ মনোযোগ ধরে রাখার মত।
আরও পড়ুন: বাণিজ্যিক সিনেমায় অনুদান বন্ধের দাবি: চলচ্চিত্র পরিষদের প্রতিবাদ
এখনো গল্প
এখনো গল্প ঠিক গল্পের চ্যানেল নয় বরং বাস্তব জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথামালা। চ্যানেলের গল্পবলিয়েরা নিজেদের এবং দর্শকসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতাগুলোকে তুলে ধরে নিজেদের কন্ঠে। ভারতীয় বাংলা চ্যানেলটির বেড়ে ওঠার গতি বেশ ধীর।
২০১৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েও এখন পর্যন্ত গ্রাহক সংখ্যা মাত্র ৪২ হাজার থেকে কিছু বেশি। মাত্র ৭৯ ভিডিওতে সর্বমোট ভিউ পড়েছে ২৫ লাখের বেশি। হরর জনরার পাশাপাশি রোমান্টিক গল্পও এই চ্যানেলটির একটি প্রধান কন্টেন্ট। সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কন্টেন্টের তালিকায় শীর্ষে আছে একটি রোমান্টিক গল্প। তবে দ্বিতীয় স্থানটি অধিকার করে আছে ‘শেষ ট্রেন’ নামের হরর গল্পটি।
ক্ষীরের পুতুল
বিখ্যাত এক সাহিত্যের নামানুসারে নির্মিত এই ইউটিউব চ্যানেলটির পরিচালকেরা হলেন সঞ্জিত মল্লিক, মৃত্যুঞ্জয় দাস এবং বিক্রম সাহা। এই চ্যানেলটির কন্টেন্ট কোন অডিওবুক নয়; গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্মাণ করা হয়েছে কার্টুন। স্বভাবতই শিশু-কিশোরদের গল্প শোনার জন্যও দারুণ একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এটি। হরর-ফ্যান্টাসি বা রূপকথার গল্পগুলোই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে এই ভারতীয় বাংলা চ্যানেলটিতে।
২০১৯-এর ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়ার পর চ্যানেলটির মোট গ্রাহক সংখ্যা দাড়িয়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজারের অধিক। ক্ষীরের পুতুলের সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো- এই দুই বছরে মাত্র ২৮টি ভিডিওতে মোট ভিউ পড়েছে ৬ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি। গল্পগুলোর অধিকাংশই সর্বোচ্চ ১১ থেকে ১৩ মিনিট দীর্ঘ। এগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ভিডিওটির শিরোনাম ‘রিক্সায় ভূত’।
আরও পড়ুন: শনিবার ‘দ্য প্যাশন অব ড্রয়িং-২’ আয়োজন করবে গ্যালারি কসমস
ফাহিমের অডিও বুক বাংলা
বাংলাদেশি ইউটিউবারদের মধ্যে রহস্য গল্প নিয়ে অডিওবুক বানানোর ক্ষেত্রে শীর্ষে আছেন অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি ইউটিউবার ফাহিম। হুমায়ুন আহমেদে রহস্য ও অদ্ভূতুড়ে গল্প শুনতে আগ্রহী হলে যেতে হবে এই চ্যানেলটিতে। এছাড়াও শ্রুতি মধুর শব্দ চয়নে বিদেশি গল্পের অনুবাদগুলো দারুণভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে ফাহিমের অডিওবুকে।
এই চ্যানেলটির যাত্রা শুরু ২০১৮ সালের ২ মার্চে। চার বছরে ফাহিমের অর্জন ৩ লাখের বেশি গ্রাহক। প্রতিটি কন্টেন্ট বেশ দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও কমেন্ট বক্সে ভক্তদের উন্মাদনা ফাহিমকে তার কন্টেন্টের অডিও গুণাগুণ আরও বাড়াতে প্রেরণা যোগায়। তার প্রমাণ মেলে তার ৩৮৯টি ভিডিওর ৩৯ লাখের বেশি ভিউতে। ফাহিমের সেরা কন্টেন্ট হলো হুমায়ুন আহমেদের ‘মিসির আলীর চশমা’।
গল্প তরু হরর
২০২০ সালের ১২ নভেম্বর পথ চলা শুরু হয় গল্প তরু হররের। এটি মূলত গল্প তরু ইউটিউবের একটি শাখা চ্যানেল। দুটোরই বিষয়বস্তু গল্প বলা বা অডিওবুক। নামের মতই গল্প তরু হররে রোমাঞ্চকর রহস্য ও ভৌতিক গল্প ফিচার করা হয়ে থাকে। ১০১টি ভিডিওতে মোট ২ লাখের বেশি ভিউয়ে সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশি চ্যানেলেও শোনা যাবে হুমায়ুন আহমেদের রহস্য গল্পগুলো। এখন পর্যন্ত হুমায়ুন আহমেদের ‘দৌলত শাহর অদ্ভূত কাহিনী’ অডিওবুকটি সেরা কন্টেন্ট হয়ে আছে। গ্রাহকের দিক থেকে যাচাই করা হলে চ্যানেলটি বেশ ছোট; মাত্র ৪ হাজারের বেশি এর গ্রাহক সংখ্যা।
গল্পকথন বাই কল্লোল
কল্লোল নামটি ইতোমধ্যে একটি ব্র্যান্ড হয়ে গেছে বাংলা গল্প শোনা লোকদের মাঝে। ২০১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে গল্পকথনের ইউটিউব অভিষেক ঘটে। দেড় বছরের মাথাতেই কল্লোল বেশ নামডাক পেয়ে যান। অবশ্য তার কন্টেন্ট শুধু হরর গল্প নিয়ে নয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক জনপ্রিয় শাখা-প্রশাখাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠে তার কন্ঠের স্পর্শে।
গত চার বছরে তিনি মোট ৫৬২টি ভিডি প্রকাশ করেছেন, যেগুলোতে সর্বশেষ মোট ভিউ পড়েছে দেড় কোটিরও বেশি। বর্তমানে কল্লোল এই চ্যানেলটির মাধ্যমে ১ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি গ্রাহককে গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন। তার ২০২১-এর ১০ অক্টোবর শুরু করা রূপকথা বাই কল্লোল নামের ইউটিউব চ্যানেলটিও ইতোমধ্যে ৯ হাজার ৯৮০ জন গ্রাহক পেয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: ঈদ উপলক্ষে মোশাররফ করিমের ‘অমানুষ’
পরিশিষ্ট
রোমাঞ্চকর রহস্য ও ভৌতিক গল্প শোনার এই বাংলা ইউটিউব চ্যানেলগুলোর গ্রাহকদের সবাই কিন্তু শিশু-কিশোর নন। টান টান উত্তেজনায় চাদরে নিচে বিছানায় সেধিয়ে যাওয়ার নেশার কাছে ছোট বেলার মত বড় বেলাও হার মেনে যায়। তাই এই দর্শকদের বিরাট অংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষজন। নস্টালজিয়া থেকেই হোক অথবা হরর গল্পের প্রতি ভালবাসা থেকেই হোক; কানে ইয়ার ফোন গুঁজে জীবন্ত হয়ে ওঠা ভয়েস ওভার আর্টিস্টদের কন্ঠে বুদ হয়ে থাকার ঝোঁক কেউই সামলাতে পারেন না। ভিডিওগুলোর পোস্টার এবং এনিমেশন ঘটনাগুলোকে চোখের সামনে এত প্রানবন্ত করে তোলে, যা সেই গল্পদাদুর নাটকীয় কন্ঠ শুনে মানসপটে ভাসতে থাকা চলচ্চিত্রের থেকে কোন অংশে কম নয়।