করোনাভাইরাস মহামারির ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ইস্পাতের কাঁচামাল (স্ক্র্যাপ) সংকটকে রডের দাম বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের রডের চাহিদার বেশির ভাগ জোগান আসে চট্টগ্রামে ভাঙা স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে। কিন্তু করোনার প্রভাবে স্ক্র্যাপ আমদানি কম হওয়ায় রডের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়েছে।
উৎপাদনকারীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ কারণে পণ্যটির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীত সামনে রেখে নির্মাণ মৌসুম শুরু হওয়ায় বাড়তি চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে রডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন উৎপাদনকারীরা।
চট্টগ্রামে বাজার ঘুরে জানা গেছে, বর্তমানে চার ধরনের এমএস রড বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বা অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৭৫ গ্রেড, সেমি অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৬০ গ্রেড ও সাধারণ কারখানায় তৈরি ৪০ গ্রেডের রড রয়েছে। এর বাইরে কোনো সিল বা গ্রেড ছাড়া এক ধরনের রড বাজারে বিক্রি হয়, যেগুলো বাংলা রড নামে পরিচিত।
ব্যবসায়ীরা জানান, এসব রডের মধ্যে ৭৫ গ্রেডের দাম বেশি বেড়েছে। এক সপ্তাহে টন প্রতি এ রডের দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। আগে যেখানে প্রতি টন বিক্রি হতো ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা, সেগুলো এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
বর্তমানে বিএসআরএম ব্র্যান্ডের প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। একেএস ও কেএসআরএম ব্র্যান্ডের প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৫৬ হাজার টাকা। জিপিএইচ ৫৪ হাজার টাকা এবং গোল্ডেন ইস্পাত টন প্রতি ৫৩ হাজার ৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
অথচ একই রড এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল বিএসআরএম ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা, একেএস ও কেএসআরএম ৫৩ হাজার থেকে ৫৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং জিপিএইচ ও গোল্ডেন ইস্পাত ৫২ হাজার থেকে ৫২ হাজার ৫০০ টাকা। একই সময়ে টন প্রতি ৩-৪ হাজার টাকা বেড়ে বর্তমানে সাধারণ ৪০ গ্রেডের প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৪৮ হাজার টাকা। এক সপ্তাহ আগে বাজারে এগুলো ৪৪-৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
দেশর অন্যতম রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কবির স্টিল রি-রোলিং মিলের (কেএসআরএম) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব বাজারে ইস্পাত স্ক্র্যাপের তীব্র ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই ক্রমাগত বাড়ছে দাম। গত দুই বছর ধরে স্ক্র্যাপের দাম অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। দাম বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রয়েছে বিশ্ব বাজারে। স্ক্র্যাপের দাম টন প্রতি ৩০০ ডলার থেকে গত এক মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯০ ডলারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় বৃদ্ধি প্রায় ৮ হাজার টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো- আশঙ্কাজনকভাবে স্ক্র্যাপের ঘাটতি। অথচ ইস্পাত শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এবং পার্সেল বুকিংয়ের জন্য অব্যাহতভাবে চাপ প্রয়োগ করছে।’
‘চীন ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে তারা তাদের দেশে স্ক্র্যাপ আমদানির অনুমতি দেবে যা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশে ইস্পাত উৎপাদনের বর্তমান সক্ষমতা বজায় রাখাও কঠিন হয়ে পড়বে। এ প্রভাব পড়েছে আমাদের স্থানীয় বাজারে। সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে রডের দাম নির্ধারণ না করা হলে ইস্পাত খাত হয়ে পড়বে স্থবির। অথচ এসব শিল্প উদ্যোক্তাদের ওপর রয়েছে বাড়তি করের বোঝা,’ বলেন তিনি।
সূত্র জানায়, সারা বিশ্বে রড তৈরির কাচাঁমালে সংকট দেখা দিয়েছে। যার প্রভাবে রডের দাম বেড়েছে। তবে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সে হারে সিমেন্ট ও রডের দাম বাংলাদেশে বাড়েনি।
চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজের মালিক এসএম কামরুজ্জামান বলেন, ‘গত ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে কয়েক দফা রডের দাম বেড়েছে। যেসব রড ১০ দিন আগে প্রতি টন ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো, এখন সেই রড বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। গড়ে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা।’
‘উৎপাদনকারীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাই আমাদের বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। নির্মাণ মৌসুম আসলে রডের চাহিদা বাড়ে। প্রতি বছর এ সময়ে উৎপাদনকারীরা দাম বাড়িয়ে দেন। কারখানাগুলোতে উৎপাদিত রডের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এরপরও অতি মুনাফা করতে চাহিদাকে পুঁজি করে রডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা,’ বলেন তিনি।
বিএসআরএম স্টিলের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘করোনাকালে লকডাউনের সময় রডের চাহিদা ও দাম দুটোই কমে যায়। দেশে নির্মাণকাজ প্রায় বন্ধ ছিল। এখন স্থানীয় স্ক্র্যাপের দাম টন প্রতি ১০ হাজার টাকা এবং আমদানি করা স্ক্র্যাপে ১২০ ডলার বেড়েছে। তাই আমাদের ৫০০ গ্রেডের রডের সর্বশেষ টন প্রতি দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬১ হাজার টাকা।’