জানা গেছে, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রায় ৫ বছর এলাকাটি ছিল পানির নিচে। সে সময় খাবার পানির সব আধার নষ্ট হয়ে যায়।
এদিকে, খুলনার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, তালা, দেবহাটা, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, মংলা, রামপাল, চিতলমারী, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট ও শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পানির সংকট আছে। এই সব এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ কমবেশি খাবার পানির সংকটে মধ্যে রয়েছে।
আরও পড়ুন: নওগাঁয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণের অভিযোগ
সরেজমিন দেখা গেছে, খুলনার দাকোপ ও কয়রা উপজেলা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে পানি সংগ্রহের জন্য মানুষগুলো দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটেন।
জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়িয়েছে। আইলার আগে এই এলাকায় এতটা পানির সংকট ছিল না। কিন্তু আইলার প্রলয়ে সুপেয় পানির সবগুলো আধার লবণ পানিতে ডুবে যায়। সেগুলো থেকে এখন আর লবণ পানি সরানো যাচ্ছে না। ফলে মিঠা পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে।
দাকোপ উপজেলার সুতারখালী গ্রামের গৃহিণী আলেয়া বেগম বলেন, ‘পানির জন্য বর্ষায় আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। বর্ষাকাল যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়, আমরা আল্লাহ’রকাছে প্রার্থনা করি। বছরের ১২ মাসের মধ্যে বর্ষাকালের ৩-৪ মাস আমরা ভালো পানি পাই। বাকি সময়টুকু খাবার পানির তীব্র সংকট থাকে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পানির আধারগুলো আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। ফলে পানির জন্য আমাদের টিকে থাকার লড়াই আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।’
খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি ঝুলন্ত গ্রামের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আগে আমরা এলাকা থেকেই খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারতাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় দাকোপ উপজেলা সদর থেকে। নৌপথে ট্রলারে করে ড্রাম ভরে পানি আনতে হয়।’
একই উপজেলার গুনারি গ্রামের রুদ্রা রানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা পানির অভাবের মধ্যে বসবাস করছি। অনেক কষ্টে খাবার সংগ্রহ করতে পারি। কিন্তু পানি সংগ্রহ করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন।’
আরও পড়ুন: টেকনাফে পানি সরবরাহ উন্নয়নে জাপান ও ইউএনএইচসিআরের সহায়তা
এই গ্রামের আরও অনেকে তাদের জীবন জীবিকার জন্য পানি সংকটকেই প্রধান সমস্যা মনে করেন। পানি সংগ্রহে তাদের অতিরিক্ত সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে।
এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ঘরে একবেলা খাবার যোগাড়ের চেয়েও এই এলাকার মানুষের সুপেয় পানি যোগাড়ে বেশি সমস্যা। চাল, ডাল, নুন, তেল সবই যোগাড় হলো; কিন্তু ঘরে সুপেয় পানি নেই। এর মানে সবকিছুই অচল।
খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়ন নদীবেষ্টিত। বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ে এই এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বহু মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে জীবন জীবিকার অন্যান্য সমস্যার সাথে এই এলাকায় খাবার পানি সংকটও তীব্র হয়েছে।
সম্প্রতি এলাকার পানি সংকট নিয়ে যুক্তরাজ্যের ইম্পোরিয়াল কলেজের সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বছরের ৩-৪ মাস বৃষ্টির পানি এই এলাকার মানুষের পানি সংকট কিছুটা লাঘব করে। অন্য সময় এদের কষ্টের সীমা থাকে না।
দাকোপ উপজেলার কালাবগি ও গুনারী গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এইসব এলাকায় খাবার পানির জন্য এখন চারটি পথ খোলা আছে। এগুলো হচ্ছে- প্রথমতো বৃষ্টির পানি। বর্ষাকালে এলাকার মানুষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। কিন্তু বড় ট্যাংকির অভাবে অনেক পারিবারের পক্ষে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত স্থানীয় ফিল্টারের পানি। স্থানীয় পর্যায়ে দু’টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লবণ পানি শোধন করে পানি খাবারযোগ্য করে। কিন্তু এর ক্যাপাসিটি মাত্র দুই হাজার পরিবার। তৃতীয় উপায় হচ্ছে উপজেলা সদর থেকে ফিল্টারের পানি সংগ্রহ। উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। সেখান থেকে নৌপথে ড্রামে করে পানি সংগ্রহ করেন অনেক পরিবার। এছাড়া সর্বশেষ অবলম্বন হচ্ছে স্থানীয় পুকুরের পানি। বাধ্য হয়ে কিছু পরিবার পুকুরের পানিতে ফিটকিরি প্রয়োগ করে ব্যবহারযোগ্য করে নেয়।
আরও পড়ুন: পানি নেই হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে, দুর্ভোগে রোগীরা
‘জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ত এলাকা সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে সুপেয় পানির সন্ধানে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে পানি কমিটি বলছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল এলাকায় লবণাক্ততার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ জলাধারের বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ এলাকার অবস্থান ব-দ্বীপের নিম্নাংশ। ফলে নদীবাহিত পলির আধিক্য বেশি। এ কারণে ভূগর্ভে জলাধারের জন্য উপযুক্ত মোটা দানার বালু বা পলির স্তর খুব কম পাওয়া যায়। আর পলির স্তর পাওয়া গেলেও এই বালুর স্তরের পুরুত্ব খুবই কম। আর কোথাও কোথাও এই বালুর স্তরের ভূমি থেকে অনেক গভীরে। সেখান থেকে মিষ্টি পানি উত্তোলন অত্যন্ত দুরুহ।’
পানি কমিটি পর্যবেক্ষণে দেখেছে, বাংলাদেশের গভীর নলকূপগুলো সাধারণত ৩০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের ৩০০ থেকে ৪০০ ফুটের মধ্যে গভীর নলকূপ বসানো যায়। কিন্তু দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় এই নলকূপের গভীরতা ৭০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসকল নলকূপের পানি তূলনামূলক কম লবণাক্ত এবং আর্সেনিকমুক্ত। তবে পলি মাটির আধিক্য, পাথরের উপস্থিতি এবং অধিক লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় সব এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না।