মিয়ানমারের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ঠিক কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তা উল্লেখ করে ঢাকার এক সিনিয়র কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমার যে মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার করেছে, ভিত্তিহীন সেসব অভিযোগ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে তাদের মিথ্যা ও অপপ্রচারের নীতি ছেড়ে এবং তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও মর্যাদার সাথে ফিরিয়ে নিতে সত্যিকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমার ইউএনজিএ-তে দাবি করেছে, বাংলাদেশ কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে। তবে এ ধরনের ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন ও সন্ত্রাসবাদের অন্য চালকদের প্রতি বাংলাদেশ জিরো-টলারেন্স নীতি বজায় রেখেছে।
ইউএনজিএ-তে সাধারণ বিতর্কের সময় মিয়ানমারের প্রতি বাংলাদেশ এ জবাব দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলটিকে আমরা কোনো সন্ত্রাসী দ্বারা ব্যবহার হতে দিচ্ছি না। মিয়ানমারের নিজেদের দিকে নজর দেয়া দরকার।’
রাখাইন রাজ্যের উন্নয়ন সম্পর্কিত, বিশেষ করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে মিয়ানমারের ‘সাজানো ও বিভ্রান্তিমূলক’ বক্তব্যের প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছে বাংলাদেশ।
দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নয়
মঙ্গলবার ইউএনজিএ’র ভাষণে মিয়ানমারের মন্ত্রী কিয়াও তিন্ত সোয়ে বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন সমস্যা কার্যকরভাবে সমাধানের একমাত্র উপায় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা।
তবে এ মন্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে রোহিঙ্গা ইস্যু দ্বিপক্ষীয় নয়, এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ জাতিগত সংখ্যালঘুদের সাথে অমানবিক আচরণের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ বলেছে, মিয়ানমারের পক্ষে এটি নতুন কিছু নয়।
বাংলাদেশ বলছে, নিজেদের জনগণের ওপর মিয়ানমারের ইচ্ছাকৃত নিপীড়নের রাষ্ট্রীয় নীতি বিদ্রোহকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং মিয়ানমারকে সংগঠিত অপরাধের প্রজনন ভূমিতে পরিণত করেছে।
ঢাকার ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের ‘অপপ্রচারের’ জবাব দিতে তৎপর ছিল এবং বলেছে যে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করে নিজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা অভিযান’ বাস্তবায়ন করতে রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ সংঘাত অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার।
জোর করে বাস্তুচ্যুত করা মিয়ানমারের ১১ লাখের বেশি নাগরিককে অস্থায়ী আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তিন বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।
জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সমস্যাটি মিয়ানমার তৈরি করেছে এবং এর সমাধান অবশ্যই মিয়ানমারকেই খুঁজে বের করতে হবে। এ সংকট সমাধানের জন্য আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ করছি।’
সাধারণ বিতর্ক চলাকালীন বাংলাদেশ উল্লেখ করে, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে কোনো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না।
সরেজমিনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ ও গণমাধ্যমের জন্য রাখাইন উন্মুক্ত করে দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘অপ্রমাণিত দাবি ও অযৌক্তিক অভিযোগ’ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দায়বদ্ধতা এড়াতে মিয়ানমারের প্রচেষ্টারই অংশ।
বাংলাদেশ সাধারণ বিতর্কে স্পষ্ট জানিয়েছে যে বাংলাদেশের সাথে স্বাক্ষরিত প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো ইচ্ছা মিয়ানমারের নেই।
৩৫০ রোহিঙ্গার বিষয়টি কী?
প্রত্যাবাসন এখনও শুরু না হলেও, কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ৩৫০ জনের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে এসেছে বলে জাতিসংঘে দাবি করে মিয়ানমার।
মিয়ানমারের এমন দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুল ওই প্রত্যাবর্তনকারীদের অবস্থান জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ।
‘এ ৩৫০ জন লোক কারা? তারা এখন কোথায়? তারা কি তাদের বাড়িতে নিরাপদে বাস করছে,’ মিয়ানমারের কাছে প্রশ্ন রাখে বাংলাদেশ।
দৃশ্যমান পদক্ষেপের আহ্বান
নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
একজন কর্মকর্তা জানান, ‘কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে মিয়ানমারের উচিত সংকট সমাধানে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া।’
এ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘকে জানিয়েছে যে মিয়ানমারকে অবশ্যই প্রকৃত সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে এবং বার বার মিয়ানমারের বোঝা বহন করার দায়িত্ব বাংলাদেশের নয়।
‘সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের স্বদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকা দরকার,’ বলেন তিনি।
সাধারণ বিতর্ক চলাকালীন বাংলাদেশ জাতিসংঘকে জানিয়েছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না কারণ মিয়ানমার সরকারের ওপর তাদের বিশ্বাস নেই।
২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে প্রত্যাবাসনের দুটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
জবাবদিহি
জবাবদিহির বিষয়টি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) সাম্প্রতিক ঘটনাবলির উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ।
পুরো বিশ্ব রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বর্বরতা দেখেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের বরাত দিয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সীমান্ত খুলে দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিলাম এবং সৎ বিশ্বাস রেখে পদক্ষেপ নিয়েছি।’
তবে রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয়ার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি আইসিজে’র এক শুনানিতে বলেন, রাখাইনে যদি যুদ্ধাপরাধ বা মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়ে থাকে তবে মিয়ানমারের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় তা তদন্ত ও বিচার করা হবে।
তবে এ বিষয়ে মিয়ানমারের বিশেষ কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি বলে জানায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বলছে, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার কারণে এখনও রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে এবং মিয়ানমার তার গণহত্যামূলক কাজের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য তথ্য বিকৃত করে চলেছে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতায় জড়িত অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনা গেলে, সেখানে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে তা রোহিঙ্গাদের আত্মবিশ্বাস জোগাতে ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকরা।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।