ডেঙ্গু প্রতিদিন যেভাবে বাড়ছে তাতে মানুষরে মধ্যে এখন ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে। হাসপাতালগুলোতে আলাদা ওয়ার্ড তৈরি করেও চাপ সামলাতে পারছে না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে আক্রান্তরা।
চলতি বছরের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৮৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছে, মশা নিধনে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। লার্ভা নিধনে নামকাওয়াস্তে অভিযান ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে মশায় অতিষ্ঠ নগরবাসী।
সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। শিশু হাসপাতালে ঘুরে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় দেখা যায়।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রচুর পানি ও জুস খাওয়ার পরামর্শ
হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, চলতি মাস অক্টোবরে প্রথম ১২ দিনে ১১৯ শিশু ডেঙ্গি নিয়ে ভর্তি হয়েছে। তেমনি ঢাকা মেডিকেল, মুগদা জেনারেলসহ কয়েকটি হাসপাতালে রোগীরা শয্যা সংকটে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আহমেদুল কবির ইউএনবিকে বলেন, দিন দিন ডেঙ্গু যেভাবে বাড়ছে তাতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা আরও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে ঢাকার বাইরেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করছেন ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের। আর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে আক্রান্তরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আব্দুস সবুর খান ইউএনবিকে বলেন, ডেঙ্গু বিস্তার সাধারণত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি কমে আসে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি অন্য রকম মনে হচ্ছে, অক্টোবর মাস এখন প্রকোপ বাড়ছে। যা উদ্বেগজনক দিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এবার ডেঙ্গু প্রকোপ নভেম্বর মাঝামাঝি বা মাসের শেষ পর্যন্ত থাকতে পারে।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে করণীয়
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। ড্রামসহ বিভিন্ন কৌটা আর খানাখন্দে পানি জমে। এগুলো খুব বেশি তদারকি হয় না। ফলে ওই সব স্থানে ডেঙ্গু মশার উৎপত্তি হয়। সিটি করপোরেশন বাসাবাড়িতে অভিযান চালাচ্ছেন। কিন্তু কনস্ট্রাকশনের জায়গাগুলো তো টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। সেখানে সাধারণ মানুষ যায় না, সিটি করপোরেশনও যায় না। যে কারণে সবসময় ডেঙ্গু মশা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
মশার নিধনে সিটি করপোরেশনের কোনো গাফিলতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব মশা নিয়ন্ত্রণ করা। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের গাফিলতি অবশ্যই আছে। মশা নিধনে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ। লার্ভা নিধনে নামকাওয়াস্তে অভিযান ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু রোধে দুটি কাজ করে। প্রথমত, হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়ার জন্য তৈরি করা। সেই ক্যাপাসিটি আমাদের আছে। আমাদের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী যারা আছেন, তাদের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আমরা আপডেটেড রাখছি। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন মৌসুমে আমরা ঢাকা মহানগরীতে সার্ভে করি। সেই রিপোর্ট আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে হস্তান্তর করি। আমাদের নতুন সার্ভে অনুযায়ী, উত্তর-দক্ষিণ দুই সিটিতেই সমানভাবে মশার উপদ্রব রয়েছে।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু প্রতিরোধে ছাদ বাগানিদের সতর্ক হতে বললেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী
ডেঙ্গু প্রতিরোধে তিনি বলেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ তখন বাড়ে, যখন মশার সংখ্যা বাড়ে। সিটি করপোরেশন এভাবে তো অভিযান পরিচালনা করে কোনো লাভ নেই। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পানি জমে আছে। ভালো করে দেখবেন, এগুলোতেই কিন্তু মশা ডিম পাড়ে। নতুন নতুন মশা জন্ম নিচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৪ হাজার ৩২৬ জন। যা গত বছর ছিল ২৮ হাজার ৪২৯ জন, ২০২০ সালে ছিল ১৪০৫ জন। তবে সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু প্রতিরোধে ছাদ বাগানিদের সতর্ক হতে বললেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী
ডেঙ্গু বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ইউএনবিকে বলেন, এবার যেহেতু ডেঙ্গু ও করোনা সংক্রমণও চলছে, তাই প্রথম পরামর্শ হলো জ্বরের শুরুতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। জ্বর অল্প, সমস্যা হবে না, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা যে কোনো মুহূর্তে খারাপ হতে পারে। ফলে শেষ সময়ে হাসপাতালে এলেও চিকিৎসকদেরও কিছু করার থাকে না। জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী অফিসার (সিইও) অতিরিক্ত সচিব সেলিম রেজা ইউএনবিকে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের বছরব্যাপী অভিযান অব্যাহত আছে। এখন ডেঙ্গু সিজন সেজন্য আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের ব্যবস্থা হাতে নিয়েছি। আমরা আশা করছি এ মাসের মধ্যেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ে অভিযান হয় না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ির নিচে ও কনস্ট্রাকশন বিল্ডিং পানি জমে ডেঙ্গু সৃষ্টি হয়। আমরা নোটিশ করছি, অনেক সময় কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ে যাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন: ৫ দিনব্যাপী দক্ষিণ সিটির ৫ ওয়ার্ডে বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু আজ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অতিরিক্ত সচিব ফরিদ আহাম্মদ ইউএনবিকে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা হার্ড লাইনে আছি, অভিযানে অনেক বাড়ির মালিককে জরিমানা করা হয়েছে। আমাদের অভিযানের পাশাপাশি সকলকে আরও সচেতন হতে হবে। সচেতন থাকলে ডেঙ্গু জন্ম হবে না।