সরকার নদী খনন এবং পলি অপসারণের মাধ্যমে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌ চলাচলের জন্য নৌপথ পুনরুদ্ধার করার পরিকল্পনা করলেও ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মাত্র সাত হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালু করতে পেরেছে।
এর মধ্যে ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার ইতোমধ্যেই চালু হয়েছে। এর মানে হলো পরিত্যক্ত নৌপথের মাত্র ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের একাধিক সূত্র থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রের মতে, ৫৩টি অভ্যন্তরীণ নৌপথ খননের একটি মহাপরিকল্পনার অধীনে প্রথম পর্যায়ে ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪টি নৌপথের ১০ হাজার কিলোমিটার পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারকারী জাহাজ মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন বলছে, কাগজে-কলমে সাত হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল করা হয়েছে। যথাযথ ড্রেজিং ও পলি অপসারণের অভাবে অনেক নৌপথ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ছে।
অধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে খনন ও পলি অপসারণের কারণে নাব্যতা উন্নয়নে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খনন যন্ত্র ও ড্রেজার স্বল্পতার কারণে আগে নদী খনন ও ড্রেজিংয়ের কাজ ব্যাহত হলেও এখন তেমন কোনো সংকট নেই।
এমওএস সূত্র জানায়, গত ১৪ বছরে বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে অক্সিলিয়ারি ভেসেলসহ প্রায় ৩৮টি নতুন ড্রেজার যুক্ত হয়েছে। এর বহরে ড্রেজারের সংখ্যা এখন ৪৫টি। এছাড়া বেসরকারি কোম্পানির ৫০টিরও বেশি ড্রেজার নদী খননে নিয়োজিত রয়েছে।
আরও পড়ুন: ঈদে নৌপথের ২৭ লাখ যাত্রীর চাপ পড়বে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে: জাতীয় কমিটি
২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জাতীয় সংসদে বলেছিলেন যে নৌপথে নাব্যতা রক্ষার জন্য ড্রেজিংয়ের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান নেওয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ’র মাধ্যমে ১৭৮টি নদী পুনঃড্রেজিং করে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ পুনরুদ্ধার করা হবে। এর আগে ২০১৯ সালের ২৫ মে নেত্রকোনায় ভোগাই-কংসা নদী খনন উদ্বোধনের সময় প্রতিমন্ত্রী একই পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের ভৈরবের কালীপ্রসাদ ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে ভৈরব-কটিয়াদী নৌপথের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের উদ্বোধন শেষে তৎকালীন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, সরকার সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি নৌপথ ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৪টি নৌপথ খনন করে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধার করার জন্য ২০০৯ সালে একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল এবং ২০১০ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। তবে বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সায়েদুর রহমান স্বাক্ষরিত হিসাব থেকে জানা যায়, উন্নয়ন ও রাজস্ব তহবিলের আওতায় ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ৮০০ কিলোমিটার নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন করা হয়েছে।
অন্যদিকে একই সংস্থার নদী নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বর্ষায় ৬ হাজার কিলোমিটার এবং শুকনো মৌসুমে ৪ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার নৌপথে নৌযান চলাচল করেছে।
২০১৭ সালে এই অধিদপ্তরের আরেকটি চিঠিতে বলা হয়েছিল যে সরকারের বিশেষ মনোযোগের কারণে নৌপথের দৈর্ঘ্য ৫৪৭কিলোমিটার বেড়েছে।
উপরোক্ত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রথম ছয় বছরে পরিত্যক্ত নৌপথ পুনরুদ্ধারে বিআইডব্লিউটিএ কোনো সাফল্য পায়নি। এছাড়া দুই দপ্তরের দুই ধরনের তথ্যের কারণে নদী খনন ও পলি অপসারণে প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার বন্ধ হয়ে যাওয়া নৌপথ খনন করা হয়েছে। এছাড়া, সমস্ত নৌপথে প্রয়োজনীয় নাব্যতা উন্নয়ন করা হয়নি। নদী খননের এই ধীর গতির কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা অসম্ভব।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন (যাত্রী পরিবহন) সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল ইউএনবিকে বলেন, ‘নদী খনন ও ড্রেজিং কাগজে কলমে করা হয়েছে। আসলে জলপথগুলো পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে না।’
আরও পড়ুন: ঈদের ছুটিতে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে ৩০ লাখ মানুষ নৌপথে বাড়ি যাবে: জাতীয় কমিটি
এছাড়া গত এক দশকে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার অনেক রুট পরিত্যক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বাদল।
তিনি আরও বলেন, তারা ড্রেজিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য একজন লঞ্চ মালিক ও একজন সাংবাদিককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ তা উপেক্ষা করেছে।
পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক, পরিবেশবিদ, প্রকৌশলী এম. ইনামুল হক ইউএনবিকে বলেন, নদী খননের কিছু মেগা প্রকল্প জনস্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে কারণ অনেক নদী অপ্রয়োজনীয় খনন করছে।
তিনি আরও বলেন, কোনো প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত নদীর আশপাশের এলাকার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা।
এম ইনামুল আরও বলেন, নদী খনন ও পলি অপসারণের প্রক্রিয়া অপরিকল্পিত।
বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার দাবি করেন, নদী খনন সঠিকভাবে হয়েছে।
তিনি ইউএনবিকে বলেন, প্রথম ধাপে ২০১০ সাল থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের ড্রেজিং নিয়ে অনিয়ম ও জবাবদিহিতার অভাবের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, যে কোনো খনন বা ড্রেজিংয়ের কাজ তৃতীয় পক্ষের হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ অনুযায়ী শুরু হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ কাজ শেষ করে নিয়মিত রুট রক্ষণাবেক্ষণ করে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন: নৌপথে দুর্ঘটনা রোধে দক্ষ মাস্টার-চালক তৈরির আহ্বান ১৫ বিশিষ্ট নাগরিকের