বাগেরহাটের কোদালিয়া-কালশিরা বিলে চলছে অবাধে পাখি নিধন। বিলের কয়েক বিঘা এলাকা জুড়ে ফাঁদ পেতে অবাধে পাখি শিকার করছে শিকারি চক্র। ফাঁদে প্রতিদিন ধরা পড়ছে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির পাখি।  

এই প্রতিবেদক সরজমিনে গিয়ে দেখতে পান, চিতলমারী থেকে উত্তর- পশ্চিম দিকে বিলের কালশিরা স্থানে কয়েক বিঘা এলাকা জুড়ে ফাঁদ পাতা রয়েছে। পাখি ধরতে কট আর লাইলনের সুতা দিয়ে ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। পানিতে কিংবা পানি থেকে এক থেকে দেড় হাত উচুতে ফাঁদ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বাঁশের খুটিতে। এছাড়া পাখি ধরার জন্য বিলে বসানো হয়েছে সোলার প্যানেল এবং সাউন্ডবক্স।  

এ সময় বিলে পাখি শিকারি ওসমান নামে এক যুবককে ফাঁদ পাততে দেখা গেছে। সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে নৌকা নিয়ে তিনি দ্রুত বিলের মধ্যে পালিয়ে যান তিনি। সারা বছর বিলে পাখি শিকার চললেও শীত মৌসুমে পাখি শিকারিদের তৎপরতা কয়েক গুণ বেড়ে যায় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। জীবিকার প্রয়োজনে ওই বিলে যাওয়া জেলে এবং শাপলা সংগ্রহকারীদের শিকারিরা নানাভাবে হুমকি দেয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।  

জানা গেছে, বাগেরহাটের চিতলমারী, ফকিরহাট ও মোল্লাহাট উপজেলা জুড়ে বিশাল বিল রয়েছে। এই বিল কোদালিয়া-কালশিরা বা জয়খা জলমহল হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন প্রজাতির অংসখ্য পাখির বিচারণ ক্ষেত্র বিশাল এই বিল। মোবাইলের সাহায্যে বিভিন্ন পাখির ডাক উচ্চ স্বরে সাউন্ডবক্সে বাজানো হয়। বিলের উপর দিয়ে উড়ে বেড়ানোর সময় পাখির ঝাঁক ওই ডাক শুনে নিচে নেমে এলে ফাঁদে ধরা পড়ে। এই বিলে ডাহক, কোরা,জলপিপি, বক, মাছরঙ্গা ও জলহাঁসসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল। আর অকেন প্রজাতির পখির বিচারণ ক্ষেত্রও এই বিল।

আরও পড়ুন: টিয়াসহ ২৩ পাখি উদ্ধার, ঠাকুরগাঁওয়ে ১ জনের কারাদণ্ড

মোল্লাহাট ও চিতলমারী উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, মোল্লাহাট-চিতলমারী জয়খা জলমহলের আয়াতন ৩৭৬ একর, যার মধ্যে ৩০৪ একর রয়েছে চিতলমারী উপজেলার মধ্যে। মোল্লাহাটের অংশে কোদালিয়া বিলের আয়াতন ৩৫ একর, মোল্লাহাট-ফকিরহাট কেন্দুয়া বিল-১ এর আয়াতন ৭৩ একর, মোল্লাহাট- ফকিরহাট কেন্দুয়া বিল-২ এর আয়াতন ২৬৫ একর, ধবলিয়া বিলের আয়োতন ২৬ একর এবং ওয়াবদা কাটাখাল জলমহলের আয়াতন ৩৮ একর।

পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাখির আবাসস্থল ও বিচারণক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে। অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে কীটনাশকের ব্যবহার এবং অবাধে পাখি শিকারের কারণে দিন দিন পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি কমছে। পাখি না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তাঁরা। পাখি রক্ষায় আইনের প্রয়োগের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।  

জীবিকার প্রয়োজনে ওই বিলে মাছ ধরতে যাওয়া জেলে কালাম শেখ জানান, শিকারিরা সারা বছর জুড়ে বিলে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে। সাউন্ডবক্সে পাখির ডাক বাজালে উড়ন্ত পাখির ঝাঁক বিলের পানিতে নেমে আসে। এ সময় শিকারিদের পাতা ফাঁদে পাখি আটকে যায়। পরে তারা ফাঁদ থেকে পাখি ছাড়িয়ে নেয়। বিলে মাছ ধরতে গেলে শিকারিরা তাদের হুমকি দেয় বলেও এই জেলে জানান।

শাপলা সংগ্রহকারী টুকু শেখ জানান, শিকারিরা ফাঁদ পেতে পাশে অপেক্ষা করে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ফাঁদে আটকা পরার পর বস্তায় ভরে রাখে। পাইকাররা এসে বিল থেকে পাখি কিনে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুন: মাগুরায় হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি, চোখে পড়ে না বাসা

বিলে শাপলা তুলতে যাওয়া ষষ্ঠ শ্রেণির স্কুলছাত্র ইব্রাহিম শেখ জানায়, দরিদ্রতার কারণে সে এই বিলে শাপলা তুলতে আসে। শাপলা তোলার পর সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলভার স্থানীয় হাটে বিক্রি করে। শাপলা বিক্রি করে যে টাকা পায় তাই দিয়ে সংসার চলে। বিলে শাপলা তোলার সময় শিকারিদের ফাঁদ নষ্ট হতে পারে এমন মনে করে শিকারিরা তাদের হুমকি দেয় বলে জানায় এই শিশু।

বাগেরহাটের চিতলমারী সদর ইউনিয়নের চেয়্যারম্যান শেখ নিজাম উদ্দিন জানান, দীর্ঘ দিন ধরে এই বিলে পাখি শিকার করা হচ্ছে। একটি চক্র বিলে পাখি শিকারের সাথে জড়িত। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় পাখি শিকার বন্ধ করার চেষ্টা চলছে।

বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শিরিনা আফরোজ জানান, পাখি নিধন রোধে আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। পাখি রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার।

ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, পরিবেশ, সাংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকার সাথে পাখি ঘনিষ্টভাবে মিশে আছে। দেশে প্রায় ৭৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। আর শীত মৌসুমে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি আমাদের দেশে আসে। পাখির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্রের স্বাস্থ্য অবস্থা ভালো যাচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন। শিকারিদের তৎপরতাসহ নানাভাবে পাখির প্রজাতি ও সংখ্যা কমছে। এজন্য পাখি রক্ষায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার কথা জানালেন তিনি।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, খাল, বিল, জলাশয়গুলো পাখির বিচারণ ক্ষেত্র। পাখিদের বিচারণক্ষেত্র এবং আবাসস্থল নিরাপদ রাখতে না পারলে পাখির জীবন হুমকির মুখে পড়বে। পাখিদের নিরাপদ রাখতে না পারলে দিন দিন পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি কমে আসবে। পাখি রক্ষায় বন বিভাগ নানাভাবে কাজ করছে। পাখি রক্ষায় আগামীতে বন বিভাগ আরও কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করবে বলেও জানান ডিএফও।   

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় পাখির অভায়ারণ্য রয়েছে। খাল-বিল,নদী-নালায় পাখি বিচারণ করে। আর শীত মৌসুমে অতিথি পাখির সমাগম ঘটে এখানে। বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন অনুসারে পাখি শিকার করার কোনো সুযোগ নেই। পাখি যাতে নিরাপদে এবং নির্বিগ্নে থাকতে পারে সে জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ফাঁদ পেতে পাখি ধরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। যারা ফাঁদ পেতে পাখি শিকারের সাথে জড়িত তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান ডিসি।

আরও পড়ুন: অতিথি পাখিতে মুখরিত কুমিল্লার পুকুর আর দিঘিগুলো