প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুনাফা লোভীদের কাজে লাগিয়ে ভাটা মালিকারা ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ ভঙ্গ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়রা জানান, মাঠ থেকে আমন ধান ওঠার পরপরই ফসলি জমির মাটি বিক্রি শুরু হয়। আর এসব মাটি ট্রাকে ও ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন ইটভাটায়া। মাটি বিক্রি করেছেন এমন কয়েকজন কৃষক জানান, ইট ভাটায় মাটি সরবরাহের জন্য এক শ্রেণির দালাল চক্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের মাটি বিক্রি করতে উৎসাহ জোগায় এবং স্বল্পমূল্যে উপরিভাগের এসব মাটি কেটে কিনে যায়। আর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কথা না জেনে এভাবেই কৃষকেরা নগদ লাভের আশায় জমির মাটি বিক্রি করেন।
ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে গিয়ে ফসল উৎপাদনে ধস নামার আশংকা করা হচ্ছে।
উপজেলার সুনই গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমার জমির পাশের জমির মালিক ইটভাটায় মাটি বিক্রি করছেন। তাকে আমরা মাটি বিক্রি না করতে অনুরোধ জানালেও তিনি অনুরোধ রাখেননি। এভাবে মাটি বিক্রি করলে ফসল উৎপাদন কমে যাবে এটাও তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছু মানুষ নগদ টাকার লোভে আমাদের কৃষির ক্ষতি করছেন।
পতিত বা চাষ হয় না এমন জমির মাটি নিচু জায়গা ভরাট, রাস্তা উঁচু বা নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য কেটে নেয়া হতো। আবার অনেকে পুকুর কাটার মাটি দিয়ে এসব কাজ করতেন। এখন ইটের ভাটায় মাটির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ফসলি জমির মাটি বেচা-কেনা হচ্ছে অবাধে।
একই গ্রামের কৃষক মামুন মিয়া বলেন, আমি এক বিঘা জমির মাটি বিক্রি করে দিয়েছি। ভাটার লোকজন এসে এস্কেভেটর মেশিন দিয়ে আমার খেতের উপরিভাগ থেকে তিন ফুট গভীর করে মাটি কেটে নিয়েছে।
সুনই গ্রামের মাটি বিক্রেতা মহসিন কবির নিরবী বলেন, তাঁর এক একর জমির উপরিভাগ থেকে তিন ফুট মাটি পাশের একটি ইটভাটায় বিক্রি করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইট ভাটার ম্যানেজার বলেন, ইট ভাটায় প্রতিদিন ২৫-৩০ ট্রলি মাটির প্রয়োজন হয়। ঠিকাদারদের কাছে কৃষকরা স্বেচ্ছায় বিক্রি করে। আমরা ওদের কাছ থেকে মাটি কিনে ব্যবসা করি। কৃষকরা না বিক্রি করলে আমরা নিতে পারতাম না।
মেসার্স বিএমএস ইট ভাটার মালিক মাহবুব ফারুকী বলেন, ‘সব মাটি দিয়ে ইট প্রস্তুত করা যায় না। ফসলি জমির মাটি ইট তৈরির জন্য উপযোগী। তাই এই মাটির চাহিদা বেশি। চাহিদা অনুযায়ী মাটি না পাওয়ায় কৃষিজমির ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়।’
পাইকুরাটি ইউপি চেয়ারম্যান ফেরদৌসুর রহমান বলেন, ‘ফসলি জমির মাটি বিক্রির বিষয়টি এখন চরম উদ্বেগের পর্যায়ে চলে গেছে। অচিরেই এটা রোধ করা দরকার। না হলে এই উপজেলায় ফসল উৎপাদনে মারাত্মক ধস নামবে। এ জন্য কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করতে পারেন। এ জন্য যদি তারা (কৃষি বিভাগ) আমাদের কাছে সহযোগিতা চায়, তবে আমরা সেটা দেব।
এ ব্যাপারে ধর্মপাশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, জমির উর্বরতা শক্তি উপরিভাগ থেকে ১৫-২০ ইঞ্চির মধ্যে থাকে। তাই ওপর থেকে মাটি সরিয়ে ফেলায় উর্বরতা শক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় সেই জমির ওপর বিভিন্ন পদার্থ জমে উর্বরতা শক্তি ফিরে আসতে শুরু করে। এভাবে আগের মতো উর্বরতা শক্তি ফিরে আসতে ১০-১৫ বছর সময় লাগে।
মাটি বিক্রি করে সাময়িক অভাব দূর হলেও ক্ষতি হয় অনেক বেশি। ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেব বলেন, কৃষি জমির মাটি ইট ভাটায় ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। অভিযোগ পেয়েছি, বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ বলেন, নিয়মনীতি না মেনে ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি এবং জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা আইনত অপরাধ। এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।