বাংলাদেশের পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন চলমান বেশির ভাগ প্রকল্প কমপক্ষে এক বছর বিলম্বিত হবে। কারণ জুলাই থেকে বর্ষা মৌসুম শুরু হবে এবং পরবর্তী শীতের আগে মাঠ পর্যায়ের কাজ করা সম্ভব হবে না।’
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই দেশের ২৫টি চলমান বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কাজ স্থগিত রয়েছে, যা বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগ কাজই চীনা ঠিকাদারদের দেয়া হয়েছিল বা এসব কাজের বেশিরভাগ সরঞ্জামই চীন থেকে আসার কথা ছিল।
পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘উহানে মহামারি শুরু হওয়ার পর হতে চীন থেকে কোনো শ্রমিক বা সরঞ্জাম আসছে না।’
তিনি বলেন, অনেক চীনা সংস্থা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পগুলোতে সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছে।
পিজিসিবির শীর্ষ এ কর্মকর্তা বলেন, যদিও চীনে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে ভাইরাসজনিত পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত খারাপ হতে থাকায় চীনা কর্মকর্তা ও কর্মী, বিশেষ করে প্রযুক্তিবিদরা ফেরত আসছেন না।
‘কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে আমাদের সঞ্চালন প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কাজগুলো স্থগিত রাখতে হচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
সরকারি সূত্র অনুযায়ী প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভারত (ঝাড়খণ্ড) থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর থেকে মোনাকাশা সীমান্তে ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন, বাংলাদেশের বিদ্যুত সঞ্চালন ব্যবস্থায় ইন্টিগ্রেটেড ক্যাপাসিটি ডেভলপমেন্ট প্রকল্প, সাউথওয়েস্ট ট্রান্সমিশন গ্রিড সম্প্রসারণ প্রকল্প, সুরজমণীনগর (ত্রিপুরা, ভারত) এবং কুমিল্লা উত্তর (বাংলাদেশ) এর মধ্যে বিদ্যুৎ স্থানান্তরের জন্য কুমিল্লা উত্তরে (বাংলাদেশ) ৫০০ মেগাওয়াট এইচভিডিসি ব্যাক-টু-ব্যাক স্টেশন নির্মাণ প্রকল্প।
এছাড়াও রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ সঞ্চালন সুবিধার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, আশুগঞ্জে নতুন ১৩২ কেভি জিআইএস সাবস্টেশন প্রকল্প দ্বারা পুরানো ১৩২ কেভি এআইএস সাবস্টেশন প্রতিস্থাপন, নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, ভেড়ামারা (বাংলাদেশ)-বহরমপুর (ভারত) দ্বিতীয় ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন (বাংলাদেশ অংশ) নির্মাণ প্রকল্প এবং বাকেরগঞ্জ-বরগুনা ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন এবং বরগুনা ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণ প্রকল্প।
এর মধ্যে কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সুবিধার্থে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে- আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প (দ্বিতীয়) (পিজিসিবি অংশ: মাতারবাড়ি-মদুনাঘাট ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন), পটুয়াখালী-পায়রা ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, পটুয়াখালী (পায়রা)-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন এবং গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি গ্রিড সাবস্টেশন নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা ও ওয়েস্টার্ন জোন ট্রান্সমিশন গ্রিড সম্প্রসারণ প্রকল্প এবং চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প।
এছাড়াও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প, দেশের পূর্বাঞ্চলে বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ প্রকল্প, বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প এবং পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে ছিল।
পিজিসিবির আওতাধীন শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, গ্রিড ভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পে শক্তি বৃদ্ধি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মূল পাওয়ার গ্রিড শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, মোংলা-খুলনা (এস) ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, আম্নুরা ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাবস্টেশনের সাথে ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, ওয়েস্টার্ন গ্রিড নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প এবং জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পও ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে।
প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার কথা উল্লেখ করে গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। তবে আগামী শীতের আগে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করা কঠিন হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরাও মাঠপর্যায়ের কাজে যোগ দিতে পারছেন না। কারণ করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে স্থানীয়রা তাদের এলকায় বাইরের মানুষকে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সরকার সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে একটি ভালো পর্যায়ে রয়েছি। তাই, এখন দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সঞ্চালন সুবিধার উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করছি।’
নসরুল হামিদ ইউএনবিকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সঞ্চালন প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন নিয়ে এখন উদ্বেগ রয়েছে।’