প্লাজমা হলো রক্তের তরল অংশ যা যখন সমস্ত লাল এবং সাদা রক্তকণিকা এবং প্লাটিলেটগুলো সরিয়ে ফেলার পর থাকে। সিপিটিতে, সুস্থ হওয়া রোগীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্লাজমা বর্তমানে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে ব্যবহার করা হয়।
সিপিটি এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পুরানো চিকিৎসা, যা ২০০৩ সালে সার্স মহামারি এবং ২০১৩ সালে ইবোলা ভাইরাসের মতো প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে সফল হয়েছে।
চিকিৎসকরা এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা (স্প্যানিশ ভাইরাস), সার্স-১ এবং মার্স ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি বের হওয়ার আগে কার্যকরভাবে সিপিটি ব্যবহার করেছেন।
জার্মান ফিজিওলজিস্ট এমিল ফন বেহরিং প্রথমে থেরাপি হিসেবে প্লাজমা ব্যবহার করার ধারণাটি চালু করেন। তিনি ডিপথেরিয়ার বিরুদ্ধে প্লাজমা সিরাম থেরাপির ব্যবহার করে ১৯০১ সালে ফিজিওলজিতে প্রথম নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুসারে, এ পর্যন্ত ৫২ লাখেরও বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৩ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি। কিন্তু এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২০ লাখের বেশি মানুষ।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় যা একটি শ্বাসযন্ত্রের রোগ। জ্বর দিয়ে শুরু হয় এবং পরে শুকনো কাশি হয়। এক সপ্তাহ পর এটি শ্বাসকষ্টের দিকে নিয়ে যায় এবং কিছু রোগীর হাসপাতালের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রবিবার (২৪ মে) পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮০ জনে।
কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের কাছ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ শুরু করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। এর আগে, ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে (পূর্বে অ্যাপোলো হাসপাতাল নামে পরিচিত) একজন কোভিড -১৯ রোগীর চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সিপিটি ব্যবহৃত হয়।
ঢামেকের চিকিৎসক ডা. জোয়ারদার রাকিন মঞ্জুর ছিলেন প্রথম প্লাজমা দাতা।
প্লাজমা চিকিৎসার জন্য জাতীয় প্রযুক্তিগত উপকমিটির প্রধান এবং ঢামেকের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট (বিএমটি) ইউনিট এবং হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এমএ খান ইউএনবিকে জানান, কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা দুই চিকিৎসক গত ১৬ মে তাদের প্লাজমা দান করেছেন।
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার জন্য সর্বোত্তম থেরাপির বিকল্পগুলো খুঁজে পেতে আরও পরীক্ষা করার জন্য প্লাজমা সংগ্রহের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশে এ থেরাপি সফল হয়েছে এবং আমরাও তাই থেরাপিটি পরীক্ষা করার চেষ্টা করছি। প্রাথমিকভাবে, বর্তমানে ঢামেকে ভর্তি ৪৫ জন রোগীর ওপর আমরা এই থেরাপিটি পরীক্ষা করব।’
তিনি বলেন, কোনো দাতার কাছ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করতে হলে ১২ হাজার টাকা মূল্যের একটি বিশেষ কিট দরকার হয়। দাতার রক্তে অ্যান্টিবডির সংখ্যা নির্ধারণের জন্য আলিজা পরীক্ষা চালাতে আরেকটি কিটের দাম পড়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
অধ্যাপক খান আরও জানান, ঢামেক ইতিমধ্যে স্পেন থেকে ৬ লাখ টাকা মূল্যের চারটি কিট অর্ডার করেছে এবং প্রতিটি কিট ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করতে সক্ষম। ঢামেক কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে পরীক্ষার ব্যয় বহন করছে এবং সরকারও তহবিল নিয়ে এগিয়ে আসছে।
‘কোভিড-১৯ রোগীরা সুস্থ হওয়ার ১৪ দিন পর রক্ত দান করতে পারেন। এই সময়ের মধ্যে শরীরে অ্যান্টিবডিগুলো তৈরি হয়ে যায়। প্লাজমা রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে। গুরুতর অবস্থার চেয়ে সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে সিপিটি গ্রহণ করলে এর কার্যকারিতা বেশি হয়,’ যোগ করেন তিনি।
গত ২৫ এপ্রিল কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সিপিটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) গত ৪ এপ্রিল সিপিটি অনুমোদন করেছে।
বাংলাদেশে এপ্রিলের প্রথম দিকে স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) অধীনে প্লাজমা চিকিৎসার জন্য একটি জাতীয় উপকমিটি গঠন করা হয় এবং ২৮ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সিপিটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এক্ষেত্রে ডিজিএইচএস’কে সারাদেশের অন্যান্য হাসপাতালেও তদারকি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ডা. খান বাংলাদেশে সিপিটি পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন কারণ ভারতসহ অনেক দেশ ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ চিকিৎসার অনুমোদন দিয়েছে।
এ বিষয়ে তিনি ইউএনবিকে বলেন, প্রস্তাবের পর তাকে প্রধান করে চার সদস্যের কারিগরি কমিটি গঠন করে সরকার।
সুস্থ হওয়া সকল রোগীকে ভাইরাসে লড়াই করা অন্যদের সহায়তার জন্য প্লাজমা দান করার আহ্বান জানিয়ে ডা. খান বলেন, ‘প্লাজমা দাতা হয়ে এগিয়ে আসতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। দাতাদের কাছ থেকে আমরা যত বেশি প্লাজমা পাবো, ততই আমরা সিপিটি ব্যবহার করে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে পারবো।’