একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটছে রাসায়নিক গোডাউনের কারণে। নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালে বলেছিলেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গোডাউন স্থানান্তরের জন্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেও এখনো ব্যবসায়ীদের তীব্র বিরোধিতার কারণে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুডাউন সড়ানো সম্ভব হয়নি।
নিমতলীর ঘটনার পর আবার চকবাজার আগুনের ঘটনায় ৭৮ জন নিহত হয়েছিল। কিন্তু এতো মর্মান্তিক মৃত্যুতে কোনও পরিবর্তন আসেনি।
সম্প্রতি গত ২৩ এপ্রিল ভোর রাতে পুরান ঢাকায় আরমানিটোলায় একটি ৬ তলা ভবনে আগুনে ঘটনায় ৪ জন নিহত। ভবনটির নিচতলায় রাসায়নিক গোডাউন রয়েছে। এই ভবনের নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত।
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম ইউএনবিকে বলেন, ২০২২ সালের মধ্যে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গোডাউন স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা হবে। মুন্সিগঞ্জে ৩০৮ একর জমিতে মাটি ভরাটের কাজ শেষ পর্যায়ে। এখানে প্রায় ১৮০০-২০০০ রাসায়নিক কারখানা করা যাবে।
সচিব বলেন, আপাতত অস্থায়ীভাবে টঙ্গীতে ৫৩টি কারখানা স্থানান্তরিত করা হবে। ইতোমধ্যে টঙ্গীতে ৭টি কারখানা স্থানান্তরিত হয়েছে। এছাড়াও শ্যামপুরে ৫৪টি কারখানা স্থানান্তরিত হবে। ইতোমধ্যে ১৯টি স্থানান্তরিত হয়েছে। বাকিগুলো তিন মাসের মধ্যে স্থানান্তর করা হবে।
পুরান ঢাকাসহ ঢাকায় কতগুলো রাসায়নিক কারখানা আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সঠিক তথ্য এখনও পাইনি। তবে মোটামুটি যা পেয়েছি সে তথ্য অনুয়ায়ী ২০০০ হবে।'
দ্রুত স্থানান্তর
পুরাতন ঢাকাসহ ঢাকা থেকে স্থায়ীভাবে এসব রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তর করতে আর কতদিন সময় লাগবে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ২০২২ সাল নাগাদ স্থানান্তর হতে পারে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পুরাতন ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুডাউন স্থানান্তরসহ এ ব্যবসার সার্বিক বিষয়ে দেখার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। সেই কমিটিতে আছেন রাজউক, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা।
সচিব বলেন, এই কমিটি কারখানা স্থানান্তর ছাড়াও দেখছে ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স, বৈধ ও অবৈধ ব্যবসায়ী এবং কারা লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য, কারা অযোগ্য ইত্যাদি।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী (সিইও) এবং সদ্য নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত রাজউকের চেয়ারম্যান এবিএম আমিনুল্লাহ নুরী ইউএনবিকে বলেন, পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুডাউন স্থানান্তরের জন্য সরকার শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। দুটি প্রকল্প হলো মুন্সিগঞ্জ ও টঙ্গীতে ।
রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, সেই প্রকল্প দুটির মধ্যে টঙ্গীরটি এই বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পথে। প্রকল্প দুটি শেষ হলে পুরান ঢাকায় আর রাসায়নিক গোডাউন থাকতে পারবে না।
কতদিন লাগবে রাসায়নিক গুডাউন স্থানান্তর করতে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্রকল্প দুটির কাজ যেহেতু শেষ পর্যায়ে, আমরা আশা করছি খুব দ্রুত সময়েই স্থানান্তরিত হবে।'
রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গোডাউন বহু পুরনো সময় ধরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেছে। দীর্ঘদিনের এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ওখানকার জনগণের সহযোগিতা ছাড়া এই মরনফাদ থেকে বাঁচা যাবে না। সরকারের সিদ্ধান্ত থাকলেও স্থানান্তরে দীর্ঘ সময় লেগেছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কারণে। সরকারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেটি খুব দ্রুতই বাস্তবায়ন হবে।
যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মোহাম্মদ খান ইউএনবিকে বলেন, পুরাতন ঢাকায় বোমার ওপর বসবাস করছে। নিমতলী ট্র্যাজেডির ১১ বছর পরেও দেশের দায়িত্বশীল সকল মহল থেকে বারবার বলা সত্ত্বেও পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরেনি। মানুষের জীবন ও সম্পদকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া হলে বর্তমানে এই পরিস্থিতি হবার কথা ছিল না ।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থাসমূহের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে প্রভাবশালী মহল ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার যে দায় আছে তাকে উপেক্ষা করে জনস্বার্থ ও মানুষের জান-মাল রক্ষায় সরকারের বলিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেউ রোধ করতে পারবে না।
ড. আদিল বলেন, পুরান ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় যেসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের মজুদ আছে, তা সার্বক্ষণিকভাবে যেকোনো ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটানোর শঙ্কা তৈরি করে রেখেছে। এই বাস্তবতায় নিমতলী, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার ঘোষিত নির্দেশনা কেন বাস্তবায়িত হল না এবং রাসায়নিক কারখানাসমূহ সরানোর উদ্যোগসমূহ কেন বাস্তবায়ন করা যায়নি সেটা অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, নিমতলী ও চূড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিক গুদমের ট্রেড লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করেছে সিটি করপোরেশন যেটা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম ও কারখানাসমূহের নজরদারি কার্যক্রম চালানো সিটি করপোরেশন এবং ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস, কারখানা অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও তা পালনে সক্ষম হয়নি সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ।
সবাইকে জবাবাদিহি করা
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) জানায়, পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সমূহগুলোর অধিকাংশই বিল্ডিং নির্মাণ বিধিমালা ও আদর্শগত মান অনুসরণ করে নির্মিত হয়নি। পাশাপাশি পুরান ঢাকায় বর্তমান পরিকল্পনা অনুসারে মিশ্র ব্যবহারের মানদণ্ড অনুসারে একই ভবনে আবাসন ও বিপজ্জনক মিশ্র ব্যবহারের কোন অনুমোদন না থাকা স্বত্বেও এ ধরনের সহবাস দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। মাস্টার প্ল্যানে নির্দেশিত ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার ব্যত্যয় করে এসব ভবনে অতি মুনাফার জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম তৈরি করা হয়েছে। 'দেশের রাজধানীর মূল কেন্দ্রে থেকে এধরনের বিপজ্জনক ব্যবসা কীভাবে দিনের পর দিন চলতে দিচ্ছি, সেটা আমাদের আধুনিক ও বসবাসযোগ্য শহর গড়বার অঙ্গীকারকে মারাত্মক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। '
কেরানীগঞ্জে বিসিক শিল্পনগরীর পাশে বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে রাসায়নিক গুদাম সরানোর যে প্রস্তাবনা ছিল, ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে প্লট ভিত্তিক শিল্প এলাকা তৈরি করে রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমাদের রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের কাজকে বিলম্বিত করছে।
পুরান ঢাকার অনেক বাড়ির মালিক অধিক মুনাফা লাভের আশায় অনুমোদনহীনভাবে রাসায়নিক গুদাম ও কারখানাকে ভাড়া দিয়ে আসছেন, অথচ তাদের অনেকেই এখন এলাকা পরিবর্তন করে পরিকল্পিত এলাকায় ঝুঁকিমুক্ত ভবনে বসবাস করছেন। এই ভবন মালিকদের অচিরেই আইনের আওতায় না আনা হলে এই সংস্কৃতি চলতেই থাকবে। পাশাপাশি অনুমোদনহীন ও অবৈধভাবে আবাসিক ভবনে বিপজ্জনক রাসায়নিক গুদামজাতকারী ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা উচিত।