ভূমধ্যসাগরীয় ঝড় ড্যানিয়েল লিবিয়ায় বিধ্বংসী বন্যার সৃষ্টি করেছে। যার ফলে উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির পূর্বাঞ্চলের একাধিক উপকূলীয় শহরে বাঁধ ভেঙে আশেপাশের এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে।
দেশটির একজন নেতা স্থানীয় সময় সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) বলেছেন, দুই হাজারের মতো মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লিবিয়ায় চলমান বিশৃঙ্খলার মধ্যে ইসলামিক চরমপন্থীদের দখলে থাকা শহর দেরনায় সবচেয়ে বেশি ধ্বংসলীলা দেখা দিয়েছে। শহরটি পুরো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
লিবিয়ার প্রশাসন দুটি পক্ষে বিভক্ত, একটি পূর্বে এবং একটি পশ্চিমে। দুই পক্ষই মিলিশিয়া ও বিদেশি সরকার দ্বারা সমর্থিত।
স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, বন্যায় সোমবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৬১ জনে দাঁড়িয়েছে। তবে এই তালিকায় দেরনা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কারণ এই এলাকাটি দুর্গম এবং সেখানে দুটি উজানের বাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এই এলাকার হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শহরের বাসিন্দাদের অনলাইনে পোস্ট করা ভিডিওতে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ দেখানো হয়েছে।
সোমবার মোবাইলে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পূর্ব লিবিয়ান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ওসামা হামাদ বলেছেন, দেরনায় দুই হাজার জন নিহত হওয়ার এবং হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেরনাকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।
পূর্বে অবস্থিত দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র আহমেদ আল-মোসমারি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দেরনায় মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেন, পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার মানুষ নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন: লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন ১৫১ বাংলাদেশি
আল-মোসমারি এই বিপর্যয়ের জন্য কাছাকাছি দুটি বাঁধ ভেঙে যাওয়াকে দায়ী করেছেন। যার কারণে এই প্রাণঘাতী আকস্মিক বন্যা হয়েছে।
২০১১ সালের বিদ্রোহে দীর্ঘ সময়ের শাসক মোয়াম্মার গাদ্দাফির পতন এবং পরে নিহত হওয়ার পর থেকে লিবিয়ায় একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অভাব রয়েছে। এর ফলে দেশটি বিপর্যয় নেমে এসেছে।
দেশটি এখন পূর্ব ও পশ্চিমে প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের মধ্যে বিভক্ত, প্রতিটি মিলিশিয়াদের দ্বারা সমর্থিত।
সিরতে শহরের সঙ্গে দেরনা নিজেই বছরের পর বছর ধরে চরমপন্থী গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এক পর্যায়ে যারা ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যতক্ষণ না পূর্ব-ভিত্তিক সরকারের প্রতি অনুগত বাহিনী ২ সালে তাদের বহিষ্কার করেছিল।
শহরের প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান আবদেল-রহিম মাজেক জানিয়েছেন, পূর্বাঞ্চলীয় বায়দা শহরে অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
অ্যাম্বুলেন্স ও ইমার্জেন্সি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উত্তর-পূর্ব লিবিয়ার উপকূলীয় শহর সুসায় আরও সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওসামা আব্দুলজালিল বলেছেন, শাহাত ও ওমর আল-মোখতার শহরে আরও সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রবিবার মারজ শহরে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
লিবিয়ান রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, দেরনায় পরিবারকে সাহায্য করতে গিয়ে তাদের তিনজন কর্মী মারা গেছে।
এর আগে রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছিল, তারা তাদের এক কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়েছে। কারণ তিনি বায়দায় একটি আটকে থাকা পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল।
পূর্ব লিবিয়া সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসাম আবু জেরিবা বলেছেন, দেরনায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, নিহতদের অনেকেই ভূমধ্যসাগরে ভেসে গেছে।
তিনি সৌদি মালিকানাধীন স্যাটেলাইট নিউজ চ্যানেল আল-আরাবিয়ায় একটি টেলিফোন সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ‘পরিস্থিতি দুঃখজনক’।
তিনি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছেন।
লিবিয়ার জন্য জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী জর্জেট গ্যাগনন বলেছেন, প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে বেশ কয়েকটি গ্রাম এবং শহর ‘গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ... ব্যাপক বন্যা, অবকাঠামোর ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়েছে।’
তিনি এক্স-এ (টুইটার) লিখেছেন, ‘দেশে (ঝড়) ড্যানিয়েলের মারাত্মক প্রভাবে আমি গভীরভাবে দুঃখিত ... আমি স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের পূর্ব লিবিয়ার জনগণকে জরুরি মানবিক সহায়তা করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এক্স-এর একটি পোস্টে লিবিয়ায় মার্কিন দূতাবাস বলেছে, তারা জাতিসংঘ এবং লিবিয়ান উভয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কীভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
লিবিয়ার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ব-দ্বীপ ওয়াদি দেরনায় ভারী বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে শহরের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে পূর্ব লিবিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী ওসামা হামাদ দেরনাকে একটি দুর্যোগ আক্রান্ত অঞ্চল ঘোষণা করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীও তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন এবং সারা দেশে পতাকা অর্ধনমিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: লিবিয়ায় আধা সামরিক দুই বাহিনীর সংঘর্ষে ২৭ জন নিহত
পূর্ব ও পশ্চিম লিবিয়া নিয়ন্ত্রণকারী কমোডোর খলিফা হিফটার বেনগাজি এবং অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুওলোতে বাসিন্দাদের সাহায্য করার জন্য সৈন্য মোতায়েন করেছিলেন।
হিফটার বাহিনীর একজন মুখপাত্র আহমেদ আল-মোসমারি বলেছেন, তারা পাঁচজন সৈন্যের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়েছে; যারা বায়দায় অবরুদ্ধ পরিবারগুলোকে সহায়তা করছিল।
সোমবার সন্ধ্যায় বিদেশি সরকারগুলো সমর্থনের বার্তা পাঠিয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ডব্লিউএএম জানিয়েছে, দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান বলেছেন, তার দেশ পূর্ব লিবিয়ায় মানবিক সহায়তা এবং অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল পাঠাবে।
তুরস্ক, যা পশ্চিমে দেশটির ত্রিপোলি-ভিত্তিক সরকারকে সমর্থন করে, তারাও প্রতিবেশি আলজেরিয়া, মিশর ও ইরাকের সঙ্গে শোকপ্রকাশ করেছে।
ঝড় ড্যানিয়েল সোমবার পশ্চিম মিশরের কিছু অংশে আঘাত হানবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দেশটির আবহাওয়া কর্তৃপক্ষ সম্ভাব্য বৃষ্টি এবং খারাপ আবহাওয়া সম্পর্কে সতর্ক করেছে।
আরও পড়ুন: অবৈধ অভিবাসন রোধে বাংলাদেশ লিবিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চায় বাংলাদেশ