সম্প্রতি পাকিস্তান ও রাশিয়া বন্ধু হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কারণগুলোও অতি সহজ।
প্রথমত- রাশিয়াকে পণ্য বিক্রি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত- পাকিস্তানকে দ্রুত ও সস্তা পণ্য কিনতে হবে।
রাশিয়া জুনের মাঝামাঝি করাচি বন্দর দিয়ে পাকিস্তানে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করেছে। পাকিস্তানে ১ লাখ মেট্রিক টন রাশিয়ান অশোধিত তেল পাঠানোর জন্য এপ্রিল মাসে এ চুক্তিটি করা হয়েছিল।
চুক্তির রাজনীতি
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বলয়ের বাইরেও এই চুক্তির প্রভাব রয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যা কিছু ঘটে, তার একটি ভারতীয় দিক থাকে। এটি চুক্তিটিও ভিন্ন নয়। রাশিয়া পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের অংশ নয়, তবে তারা ভারতের ঘনিষ্ট।
কিছু সূত্রের তথ্যমতে, এই সম্পর্কটি (ভারত-রাশিয়া) নাকি চাপের মধ্যে আছে। এগুলো মূলত মার্কিন সূত্রের খবর।
আরও পড়ুন: রাশিয়ার সংসদীয় গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বৈঠক
পরিস্থিতি থেকে আরও বোঝা যাচ্ছে, আজীবনের বন্ধু বা ‘আমার বন্ধু, তোমার মিত্র’- টাইপ ভাবনার মডেলের সংস্কার চলছে; পরিবর্তন এসেছে।
সুন্দরভাবে যেটিকে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বলা হয়, সেখানকার নেতা ও মানুষেরা এতটাই বোকা না যে তারা সবকিছু মেনে নেবে। এমনকি এখন তারা পশ্চিমসহ কোনো ব্লকের প্রতি স্থায়ী আনুগত্যে বিশ্বাস করে না।
মস্কো, পশ্চিম, বেইজিং এবং এমনকি বহিরাগত এলিয়েনও যদি এগিয়ে আসে, অনেকে তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরির জন্য আগ্রহীI আর ইউক্রেন যুদ্ধ এই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করেছে।
রাশিয়া ও পাকিস্তান ছিল স্নায়ুযুদ্ধে একে অন্যের ঘোর শত্রু। বিশেষত ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন রাশিয়া ভারতকে সমর্থন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে।
অন্যদিকে, চীন সেসময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন বন্ধু ও মিত্রদের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল। সেসব পুরনো কথা।
দৌড়ের ওপর কঠিন সিদ্ধান্ত
তবে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে সম্পর্ক একটু ভাল হয়েছিল, কারণ তাদের যৌথ স্বার্থ ছিল। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ দমন এবং তালেবানের সঙ্গে পুনর্মিলনের বিষয়।
২০২২ সালে যখন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মস্কো সফর করেন, তখন এজেন্ডার শীর্ষে ছিল তেল বা এনার্জি।
ততক্ষণে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। এতে বিশ্বজোড়া সম্পূর্ণ নতুন একটি জগাখিচুড়ি তৈরি হয়েছে এবং এর ফলাফল এখনও অস্পষ্ট।
কিন্তু পরিস্থিতি অনিশ্চিত হওয়ার কারণেই ছোট/দুর্বল দেশগুলো দৌড়ের ওপর খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
পাক-রাশিয়া এপ্রিলের তেল চুক্তিটিকে ‘ট্রায়াল রান’ বলা হয়েছিল, তবে স্পষ্টতই তেলের ড্রামে এর চেয়ে আরও বেশি কিছু রয়েছে।
স্পষ্টতই পাকিস্তান রাশিয়ান অপরিশোধিত দিয়ে তার ট্যাঙ্কের এক-তৃতীয়াংশ পূরণ করার পরিকল্পনা করছে, যার অর্থ তারা শুধুমাত্র মধ্যেপ্রাচের তেলের ওপর নির্ভর করতে চায় না, যা বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা নতুন হিসাব-নিকাশ তৈরি করছে।
অন্যদিকে, রাশিয়াও ‘দিল’ খুলে বন্ধুত্বের বোতলে তেল ঢালছে।
এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৭৫ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ উর্দুতে ‘পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ক দীর্ঘজীবী হোক’- বলে তার বক্তৃতা শেষ করেন।
এ নিয়ে টলস্টয় কি ভাববেন সেটা জানা যায় নি।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ২০২৩-২৪ সালে অর্থনীতির সব খাতে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে: প্রতিবেদন
ভারতকে কি একটু চিন্তায় ফেলেছে?
রাশিয়া ও চীনের বন্ধুত্বের বিষয়টি প্রাক্তনের সঙ্গে রোম্যান্স পুনরুজ্জীবিত করার একটি ক্লাসিক উদাহরণ। একইসঙ্গে উভয়ই একসময় ‘সমাজতান্ত্রিক’ ব্লকের অংশ ছিল, যা ১৯৬১ সালে ভেঙে যায়।
তবে সম্পর্কের মেরামত চলছে এবং উভয়ই অস্ত্রের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। এটাই নয়াদিল্লিকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করছেI সে আশঙ্কা করছে যে মস্কো তার নতুন প্রেমিক চীনকে বেশি পছন্দ করতে পারে এবং তার সঙ্গে অস্ত্র সহযোগিতা কমাতে পারেI
তবে এটি এখনও ঘটেনি, যদিও মার্কিনিরা খুব আশাবাদী যে অচিরেই এমনটা ঘটবে।
নতুন অংক, পুরনো শত্রু
ভারত বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার নয়া মাখামাখি’র ভবিষ্যত সম্পর্কে সতর্কI তবে তারা বলছে যে এটি পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নয় এবং মস্কো ও ইসলামাবাদের মধ্যে সমীকরণ ইতিবাচক; তবে দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়।
কারণ পাকিস্তানের পকেট ছিঁড়ে গেছে এবং তারা মস্কোকে বেশিদিন অর্থ দিতে পারবে না; কারণ তার (রাশিয়ার) নিজের পকেটও মেরামত করা যথেষ্ট প্রয়োজন।
তবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হতে পারে যে রাশিয়ার সঙ্গে খুব বেশি প্রণয় করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করে। আর পাকিস্তানের এখন তাদের ভীষণ প্রয়োজন।
সুতরাং, পশ্চিমা দেশগুলো যে তেলের দাম নির্ধারণ করেছে, পাকিস্তানকে তা মেনে চলতে হবেI না হয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে।
মার্কিন, রাশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে নগদ টাকার ঘাটতির কারণে রাশিয়া আর নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী নয়, কিন্তু ভারত এই খেলায় পুরানো পাপী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ালেও ভারত এখনও রাশিয়ার সঙ্গে একটি ‘সব সময়ের বন্ধু’-মার্কা পোজ দিচ্ছে।
কারণ ভারত নিশ্চিত হতে চায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত বিয়েতে গেলে সে রাশিয়ার চেয়ে ভাল পার্টনার পাবেI তবে ভারত নিশ্চয়ই শিশু বা কিশোরীর মতো মালাবদলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না, কারণ এতে অর্থ জড়িত; আর এটাই আসল কথা।
এখন দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই আর কোনো সরবরাহকারী কাম সুপার পাওয়ারের সঙ্গে একচেটিয়া সম্পর্ক করার চুক্তিতে যাচ্ছে না। সব দরজা খোলা রাখতে চায় সবাইI আর এটা শুধু ভারত ও পাকিস্তানই করছে, এমন না।
বাংলাদেশ যেমন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অনুমোদিত কয়েক ডজন রুশ জাহাজ তার বন্দরে ভিড়তে বাধা দিয়েছে, অন্যদিকে আবার রাশিয়ার সঙ্গে চীনা মুদ্রায় লেনদেন অব্যাহত রেখেছে।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: রাশিয়ার থ্রিডি-প্রিন্টেড রকেট উৎক্ষেপণের পরপরই ব্যর্থ!