কাঁঠালিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে অম্পিনগর
২৪ এপ্রিল ১৯৭১। কাঁকড়ি নদীর পশ্চিম তীরে বাজার সংলগ্ন বি এস এফ ক্যাম্প। পূর্ব তীরের জঙ্গলে আমাদের ক্যাম্প। উঁচু পাহাড়ের উপরিভাগ সমতল। এখানেই তাবু ফেলে থাকার জায়গা করা হয়েছে। থাকা বলতে একটা তাবুতে গাদাগাদি করে কোনোমতে শোয়ার ব্যবস্থা। অনেকে এক কাপড়ে এসেছে। বেশিরভাগ যুবকদের হাতে টাকা পয়সা নেই। সহায় সম্বলহীন ভাবে ঘর বাড়ি ছেড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ক্যাম্পে উঠে এসেছে। পরিবার পরিজনরা হয়তো শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নিয়েছে।
ক্যাম্পটি পরিচালিত হয় বিএসএফ এর তত্ত্বাবধানে। তদারকি করেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা। ক্যাম্পে রিপোর্ট করার পর আমাদের নাম ঠিকানা লেখা হল। যেহেতু আমার কিছুটা লেফট রাইট জানা ছিল, সেহেতু আমাকেই আমাদের দলনেতা বানিয়ে দেয়া হল। মোস্তফা ভাই এবং অন্য বড় ভাইরা থাকতে আমাকে দল নেতা হতে হল। আগা মাথা কিছু বুঝি না। কেউ আমার কথাও শোনে না। নাম ঠিকানার তালিকা বানিয়ে নিয়ে বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে অফিসারকে দিতে হবে।
কাঁকড়ি নদীর হাটু পানি ডিঙ্গিয়ে বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে অপেক্ষা করছি। এই নদীর পানি আমাদের খাওয়া গোসল এবং সকল কাজের সাথী। পরিস্কার পানি। কিছুক্ষণ পর অফিসার মেসে ডেকে নেয়া হল। মেসের বাইরে নদীর পার ঘেঁষে লনে ইজি চেয়ারে অফিসার বসে আছে। সাদা হাফ প্যান্ট জঙ্গল বুট সাদা টি শার্ট পরা স্মার্ট অফিসারকে সালাম দিলাম। মনে মনে ভাবছি হিন্দুকে নাকি মুসলমানের সালাম দেয়া যায় না। গুনাহ হলো না তো? ভদ্র লোকের মার্জিত ব্যবহার। আমার সমস্যা হলো হিন্দি ও ইংরেজি বুঝি। কিন্তু বলতে গেলে আটকে যায়। ভালো বলতে পারি না। অফিসার তার সুন্দর কথা বার্তায় মুগ্ধ করলো। জড়তা কেটে গেলো।
ক্যাম্পে ফেরত এলাম। একশটা অভিযোগ। এটা নেই, ওটা নেই, কিছু পাইনি, খাবার পাইনি। সকলের কিছু নাইয়ের মাঝেও এটা ওটা হারানোর অভিযোগ। সামাল দিতে পারছি না। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, ‘পাগল ধরে বউ বানানো’। আমার মত জুনিয়র গোবেচারাকে টিম লিডার বানিয়ে শাস্তি দেয়া হচ্ছে কেন বুঝলাম না।
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-১
বিকেলে আমাদের বাঙালি অফিসাররা ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন। তিনজন। একজনের হাতে ব্যান্ডেজ । আমাদের দলে ফিসফিসানি শব্দ। ব্যান্ডেজ হাতে অফিসার হলেন ক্যাপ্টেন হায়দার। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর চৌকশ কমান্ডো। অত্যন্ত উঁচু মানের পেশাগত সৈনিক। কমান্ডোরা এত দুর্ধর্ষ যে তারা আকাশে ওড়া থেকে পাতাল ফুড়ে নিচে নামতে পারে। ভীষণ ব্যাপার। সবাই কমান্ডো হতে পারে না। এই কমান্ডোর নেতৃত্বে আমরা গেরিলা ট্রেনিং নেবো ভাবতে ভালো লাগছিল। এই মুহূর্তে আমাদের গেরিলা ট্রেনিং দরকার। অপর একজন অফিসারের কথা মনে পড়ে যায়। ফরসা চেহারা, গাল দুটো গোলাপি আপেলের মত। দেখলে পাঞ্জাবি পাঞ্জাবি মনে হয়। তিনি ক্যাপ্টেন আকবর। ( প্রয়াত কর্নেল আকবর, এক সময়ের মন্ত্রি) কুমিল্লার লোক। নানুয়ার দিঘির পারে বাসা। নাম শুনেছি এবার দেখলাম। ক্যাপ্টেন হায়দারসহ অন্যরা হাবিলদার সুবেদারদের কিছু আদেশ নির্দেশ দিয়ে পাহাড়ের চুড়ায় আরও উঁচুতে তাদের ক্যাম্পে চলে গেলেন। তবে তারা যখন আদেশ নির্দেশ দিচ্ছিলেন তখন তা বাংলা ও উর্দুতেই বলছিলেন। হতাশ হলাম, উর্দু এখনও আমাদের ছাড়তে পারেনি।
খাবারের সমস্যা প্রকট। তিন বেলা তো দুরের কথা এক বেলাও পূর্ণ আহার জোটে না। যদিও পাওয়া যায় তা হলো জাউ ভাত। রিফুজি ক্যাম্প থেকে আনা আতপ চাউল ও ডাল। ডাল বলতে হলুদ রঙের পানি। লবণ কখনই হয়না। থালা বাসন নেই। কিভাবে খাবে? গ্রেনেডের গোলাকার কন্টেইনার কেটে কি এক অদ্ভুত প্লেট বানানো হল। সারা ক্যাম্পে নাই নাই দাও দাও রব। কেউ কারো কথা শুনতে চাচ্ছে না। হাবিলদার সুবেদার সাহেবরা উর্দুতে গালাগাল দিয়েই যাচ্ছেন ‘শালা, আমরা তো আর্মিতে ভালই ছিলাম। বেতন রেশন কাপড় চোপড় সবই পেতাম। তোমরা শালারা আন্দোলন করে সমস্যা লাগিয়ে রেখেছ বলেই আজ আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছি’।
ক্যাম্পের অযুত সমস্যা সমাধানের রাস্তা কই? একদল ছাত্র যুবক স্লোগান দিচ্ছে ‘ভাত কাপড় চাইনা, অস্ত্র চাই, গ্রেনেড চাই, আমরা থাকতে খেতে আসিনি, আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি’।
এটা কে দেবে? ভারত? কেন দেবে। কোন চুক্তি আছে? দিলেও দেয়ার একটা পদ্ধতি তো থাকবে। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। সরকারে সরকারে কোন সমঝোতা হয়েছে? এখানে সরকারের প্রতিনিধি কে? সেনা ইউনিট থেকে পালিয়ে আসা সেনা অফিসার ও সদস্যরা কোথা থেকে অস্ত্র ও অর্থ দেবে। সম্পদ কোথায়? দিক নির্দেশনা কি? নেতারা এখনও দেখা দেননি। শুনেছি ছাত্র জনতার রোষ এড়াতে তারা এদিকে আসছেন না। ব্যাংক লুটের টাকাগুলো কি এখন খরচ করা যায় না? ছাত্র জনতা কোন কোথা শুনতে রাজি নয়। শুধু চাই, আর চাই।
হাবিলদার সুবেদাররা উত্তেজিত ছাত্র জনতাকে শান্ত করতে পারলেন না। ফেইল। ক্যাপ্টেন হায়দারসহ অফিসাররা উপর থেকে নেমে এলেন। ফরসা গোলাপি গায়ের রঙয়ের ক্যাপ্টেন সাহেব সবাইকে শান্ত হতে বললেন। না কোন কোথা কেউ শুনছে না। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন সাহেব এমন গালি দিয়ে বকা শুরু করলেন যা আমরা জীবনেও শুনিনি। কল্পনায়ও না। বাংলা উর্দু ইংরেজির সব গালি মেশিন গানের গুলির মত বর্ষিত হল। ক্যাপ্টেন আকবরের মুখ আরও লাল হয়ে গেছে। ছাত্র যুবকরা বুঝতে পারল চাওয়ারও তো একটা সীমা আছে।
আরও পড়ুন: ঢাকায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
সবাই তাবুতে ঢুকে গেলো। বড় ভাইয়েরা রসিয়ে রসিয়ে অন্যদের বোঝালেন, ‘বুঝেছ? এটা হল মিলিটারি গালি। কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে সবাই। ডান্ডা না হলে বাঙালি ঠাণ্ডা হয় না’।
প্রশিক্ষণ শুরু হল। এটেনশন, স্ট্যান্ড অ্যাট ইজি, রাইফেলের লোডিং আনলোডিং ইত্যাদি। হায়দার ভাই কালো সানগ্লাস লাগিয়ে দূর থেকে দেখে যান।
প্রশাসন ব্যবস্থার কিছু উন্নতি হল। একদিন জানিয়ে দেয়া হল কাল গরু জবাই হবে। অন্তত একদিন হলেও গোশত খাওয়া যাবে। হায় খোদা। গরু জবাই হলো। কিন্তু মাংসের টিকিটি ও পাওয়া গেল না। শুধু আঁশ পাওয়া গেলো। বলতে গেলে এটা হয়েছে মাংসের ডাল। জাউ ভাতের সঙ্গে মাংসের মিলন হলো না।
ভরসা থাকলো ত্রিপুরার অফুরন্ত কাঁঠাল ও আনারস। দাম খুবই কম। বেশির ভাগ ছেলেদের পকেটেই টাকা নেই। দু একজনের টাকা আছে। ওরা বাজারে গিয়ে ভারতীয় আর্মির মত অলিভ গ্রিন কাপড় দিয়ে প্যান্ট বানাচ্ছে, জঙ্গল বুট কিনছে আর শিখদের মত হাতে খাড়ু পড়ে ‘রাম রামজি’ খেলছে। (ভারতীয় সৈনিকরা একের সঙ্গে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে রাম রামজি বলে)।
ক্যাম্পে প্রতিদিনই ছাত্র যুবকরা আসছে। প্রশিক্ষণ চাই, অস্ত্র চাই। ক্যাম্পে ঠাঁই নেই। এত লোক কোথায় জায়গা দেয়া হবে। এরই মধ্যে সবার বিশ্বাস জমে গেলো যে এ যুদ্ধ দু’ এক মাসে শেষ হবে না। পাক বাহিনী শহর ছেড়ে গ্রামে গঞ্জে হামলা শুরু করেছে। যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করে মাটি চাপা দিচ্ছে। এখন কিছু কিছু পাকিস্তানি সাপোর্টার টুপি লাগিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদে মাতোয়ারা।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক বিহারিকে হত্যা করা হয়েছে। আজ বিহারিরা উঁচু গলায় কথা বলছে। স্কুল কলেজ বন্ধ। তাই যুবকদের ভারতমুখী হওয়ার বিকল্প নেই। ভারতে যাদের আত্মীয় স্বজন আছে তাদের আশ্রয় জুটেছে। অন্যরা কোথায় যাবে? শরণার্থী শিবির এখনও তৈরি হয়নি। থাকা, রান্না বাড়া, খাওয়া সব কিছু খোলা আকাশের নিচে চলছে। ট্রাকে করে আতপ চাউল, ডাল তেল এনে বিতরণ করা হচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
রও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা