স্বাধীনতার পর প্রথম নববর্ষের কথা মনে পড়ে কিন্তু তাতে অনেক অস্পষ্টতা। যেন দিনগুলো একসঙ্গে মিশে গেছে। একে অপরের সঙ্গে এতটাই এক যে আজকের এবং গতকালের মধ্যে তফাৎ বোঝা কঠিন। সেই সময়ের দিনগুলো, কাদের ও কী ছিল নিশ্চিত হওয়া যায় না। ১৬ ডিসেম্বর যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছিল তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কারণ নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের খবর আসতে থাকে।
লোকেরা অবাক হয়ে ভাবল কারা এই ভেতরের শত্রু। যারা আত্মসমর্পণ করেছিল তারা ছিল সরকারি বাহিনী। কিন্তু ঘরের ভেতর, নিজেদের যারা, খুনি ও হত্যাকারীরা, তারা তো জীবিত ছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও তাই অনেকে নিজেদের বন্দুক হাতছাড়া করতে চায়নি। বুলেটের বিস্ফোরণের আওয়াজ যে কোনো রাতে বেজে উঠত, তখন বোঝা যেত সেগুলো কেবল "বীরত্ব" দেখানোর চেষ্টা ছিল না, একটা ফ্যান্টম ভয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ, কারণ খুনিরা এখনও চারপাশে লুকিয়ে আছে। তাদের জানান দিচ্ছে আমরা আছি, রাইফেল আছে সঙ্গে।
২
কিছু মানুষ অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে। আজকাল লোকে যখন ভাবে যে এই তো গতকাল পর্যন্ত আমি খারাপ ছিলাম না, আমি আশ্চর্য হই, নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, ‘তারা কি ভেবেছে যে আমরা এইমাত্র পাপ ও লুটপাট, ঘৃণা ও চুরি আবিষ্কার করেছি? তারা কি মনে করে যে আমাদের অপরাধ প্রবণতা একটি সাম্প্রতিক উদ্ভাবন? আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা সবাই ১৯৭১ সালে সাধু ছিলাম এবং সম্প্রতি পাপী হয়েছি?’ আমি জানি এটি এমন নয়। আমাদের গৌরব ও বিশ্বাসঘাতকতা উভয়ের সঙ্গে মিশ্রিত একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
৩
স্বাধীনতার পরপরই, সর্বত্র গোলাগুলি হচ্ছিল এবং কেউই জানত না কী ঘটছে। ঢাকা শহর প্রকৃতপক্ষে কারো নিয়ন্ত্রণে ছিল না যদিও ভারতীয় সেনাবাহিনী বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। চারদিক থেকে বাংলাদেশি সৈন্যরাও প্রবেশ করছিল। বেশিরভাগই বেসামরিক এফএফ ছিল যারা হেঁটে ফিরছে শহরে।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর সৈন্য, যাদের স্বাগতম জানায় সবাই। কিন্তু কয়েকদিন পর পল্টন ময়দানে সবার সামনে বিহারি রাজাকারদের হত্যা করে বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচুর নিন্দা কুড়ায় সে। কেউই এই ধরনের কাজ সমর্থন করেনি।
৪
আগে শীতকালে শীত পড়ত কিন্তু সে বছর সবাই কোনো না কোনো কারণে খুব শীত অনুভব করেছিল। মিরাজ আলী তার গ্রামে ফিরতে আগ্রহী হলেও থেকে যান। তিনি একজন ছোট দোকানদার কিন্তু দোকান বন্ধ করেননি। বলেন যে তার কাছে এক মাসের মালের স্টক রয়েছে এবং আশেপাশে ইতোমধ্যে জিনিসপত্রের অভাব দেখা দিয়েছে। যতদিন মাল আছে তিনি অপেক্ষা করবেন। তার বাবা-মা অসুস্থ, তার ভাই যুদ্ধে গেছেন। বাড়িতে কেউ নেই, তাই ফেরার দরকার ছিল কিন্তু তিনি যাননি। কয়েক মাস পরে তার সঙ্গে দেখা হয়। তখন শেষবার তার দোকানটি বিক্রি করে বন্ধ করে চলে যাচ্ছিলেন দেশে। তার বাবা মারা গেছেন আর তার ভাই ফিরে আসেননি। আমার ভাই বোনদের জন্য কিছু চকলেট লজেন্স দিয়ে চলে যান।
৫
আমার কিছু এফএফ বন্ধুরা একটি পার্টির আয়োজন করেছিল। সবাই আগের চেয়ে বেশি জোরে হাসছিল, কৌতুক করেছিল। প্রায় এক বছর নীরবতার পরে, কণ্ঠস্বর মুক্ত হতে পেরেছে। মুক্তি শুধু পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নয়, নীরবতার কাছ থেকেও। মদও ছিল টেবিলে কিন্তু সবাই পান করেনি। আমার মনে আছে সবার গল্পগুজব, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। কিন্তু সব গল্প পুরা সত্য ছিল না। এটা ঠিক, ভয় থেকে মুক্তি কল্পনাকেও মুক্ত করে। আমার খুব অদ্ভুত দুজন অতিথির সঙ্গে দেখা হয়। উভয়ই ভারত থেকে এসেছে। একজন ব্যবসায়ী যিনি স্বাধীনতার এক দিন পরেই পৌঁছে যান, এরই মধ্যে বন্ধুত্ব করেছেন অনেকের সঙ্গে, কথা বার্তা হচ্ছে। অন্যজন ছিল বেশ হাসি খুশি এক তরুণ। পরে জানলাম কলকাতা থেকে আশা নকশাল পাতি নেতা, এতদিন খুলনায় ছিল এবং ঢাকায় এসে যোগাযোগ শুরু করে। ১৯৭৫ এর পর আর দেখা হয়নি তাদের সঙ্গে।
৬
রাতে আমি সামাদের পরিবার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। নভেম্বরে তাকে হত্যা করা হয়, লাশ দাফন করা হয় ভারতে। বাড়িতে সবার মন খারাপ ছিল। তার বোন আমাকে জানায় যে, তার মা জায়নামাজ থেকে ওঠেননি। ছোট্ট বসার ঘরে বাবা শুধু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম, তিনি তাকালেন, আমাকে দেখে আবার নিজের স্তব্ধতার কাছে ফেরত গেলেন। কিছুক্ষণ পর সালাম দিয়ে চলে এলাম। তিনি সাড়া দেননি।
আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। দুই পাশে নীরব ও সরব বাড়িগুলার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম কে বাস করে সেখানে। কেবল হাঁটতে থাকলাম যতক্ষণ না আমি শুনতে পেলাম আমাদের বাড়ির কাছে বিপিন বাবু মাতাল হয়ে কিছু ভুলে যাওয়া গান গাইছেন আগামীর বছরগুলোকে স্বাগত জানিয়ে।