বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বর্তমান সংকটের জন্য সরকারের ‘ব্যাপক দুর্নীতি, আত্মঘাতী চুক্তি এবং ভ্রান্ত পরিকল্পনা’কে দায়ী করেছে বিএনপি।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি ও ব্যাপক লুটপাটের মূল্য এখন সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে। দুই-তিনজনের জন্য লোডশেডিং। শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এবং গ্রামাঞ্চলে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা বিদুৎ থাকছে না। জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
শনিবার বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন। তিনি সম্মেলনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব কালো আইন ও বিধিবিধান বাতিল, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের চুক্তি বাতিল এবং অনুসন্ধানসহ ১২ দফা পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তাদের দল ক্ষমতায় এলে বঙ্গোপসাগর থেকে গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য খনিজ সংগ্রহ করবে বলেও তিনি জানান।
ফখরুল বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যখন মানুষকে ভীষণভাবে আঘাত করছে, তখন লোডশেডিং সেই কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। কারণ তাদের পিঠ দেয়ালের ঠেকে গেছে।’
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি সব ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট এবং পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে তুলে সরকারকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান।
অন্যথায়, তাদের দল সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই বিএনপি নেতা।
ফখরুল বলেন, ১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট অপ্রয়োজনীয়ভাবে এখনও চালু রয়েছে, যদিও সেগুলো চালু হওয়ার ২/৩ বছর পর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জে মোটা অংকের টাকা পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘সরকারকে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই ক্যাপাসিটি চার্জে ৯০ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জ অযৌক্তিক, অনৈতিক এবং জনস্বার্থের পরিপন্থী। এটাও একটা অপরাধ।’
তিনি বলেন, দেশের মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ এখন ব্যবহার হচ্ছে। বাকি ৫৭ শতাংশ নিষ্ক্রিয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই ভাড়া হিসেবে টাকা পাচ্ছে।
ফখরুল বলেন, অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে আরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে যা কেবল নিষ্ক্রিয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে।
ফখরুল বলেন, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে। ‘বর্তমানে ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এর জন্য, গত তিন অর্থ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ভারতীয় আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ‘বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ ওভার ক্যাপাসিটি থাকা অবস্থায় ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।’
বিএনপি নেতা বলেন, এই বিদ্যুতের আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ যায় ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে। ‘বাংলাদেশকে ২৫ বছরে আদানি গ্রুপকে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে, যা তিনটি পদ্মা সেতু, নয়টি কর্ণফুলী টানেল বা দুটি মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য যথেষ্ট।’
তিনি বলেন, আদানি গ্রুপকে তিন বছরে মোট ভাড়া দেয়া হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতিসহ মোট ব্যয় ৩০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
সরকার গ্যাস অনুসন্ধানের সক্ষমতা না বাড়িয়ে আইপিপি’র মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জনগণের ওপর অন্যায়ভাবে বড় বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন ফখরুল।
আরও পড়ুন: এটা জনগণের সঙ্গে তামাশা, মোমেনের মন্তব্য নিয়ে বিএনপি
তিনি বলেন, ‘সরকার গত দশ বছরে অফ-শোর গ্যাস অনুসন্ধানের সম্ভাবনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করেনি।’
এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, তাদের দল ক্ষমতায় ফিরলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট সমাধান করবে। ‘আমরা কুইক এনহ্যান্সমেন্ট অব ইলেক্ট্রিসিটি অ্যান্ড এনার্জি সাপ্লাই (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট এবং কুইক রেন্টাল কোম্পানির সঙ্গে সমস্ত চুক্তিসহ সমস্ত কালো আইন বাতিল করব৷ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে করা হবে।’
তিনি বলেন, তাদের দল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতেও পদক্ষেপ নেবে।
এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলে জানান বিএনপি নেতা।
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ লাইনগুলি জরুরিভাবে স্থাপন করা হবে।’
ফখরুল বলেন, তারা বাপেক্স এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় গ্যাস ও খনিজ অনুসন্ধানে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি: নয়াপল্টনে চলছে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ