সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে শূন্যের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করা আর প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া যেন একই সুরের ঐকতান। আর সেই সংগীত যেন অনুনাদে বাজতে থাকে শীতের শুরুতে। শীতে নেই অল্পতেই দম ফুরিয়ে যাওয়ার চিন্তা। বরং আকাশ আর পাহাড়ের মাঝে মেঘ আর কুয়াশার প্রতিযোগিতা অ্যাড্রেনালিন বাড়িয়ে দেয় মাঝপথে থেমে যাওয়া কোনো পর্বতারোহীর। ট্রেকার আর রোমাঞ্চপ্রেমীরা এই কারণেই শিশির মাখা ঋতুকে বেছে নেন তাদের দুর্গমপ্রিয় উচ্ছ্বাসের বাঁধ ভাঙানোর জন্য। দেশে ট্রেকিংয়ের জন্য অন্যতম সেরা গন্তব্যের নাম তাজিংডং। বিপজ্জনক ঝিরিপথ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া নিয়েই আজকের নিবন্ধ। চলুন, দুর্গম চূড়াটির অভিমুখে রওনা হওয়ার পূর্বে পুরো যাত্রার ব্যাপারে সম্যক ধারণা নেয়া যাক।
তাজিংডংয়ের অবস্থান ও বিশেষত্ব
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ী অঞ্চল বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন রেমাক্রী পাংশা। এই ইউনিয়নের সাইচল নামের পর্বতসারির অংশ তাজিংডং। উপজেলা সদর থেকে জায়গাটির দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার।
প্রকৃত উচ্চতা ৭৮৯ মিটার (2,৫৮৯ ফুট) হলেও সরকারি হিসাব মতে ১ হাজার ২৮০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই প্রাকৃতিক বিস্ময়টি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এর আগে দেশের চূড়াগুলোর মধ্যে উচ্চতার দিক থেকে শীর্ষস্থানে ছিল কেওক্রাডং।
অবশ্য বেসরকারি গবেষণায় এই খেতাবের দাবিদার সাকা হাফং চূড়া , যা এখনও সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
আরও পড়ুন: বান্দরবানের তিনাপ সাইতার জলপ্রপাত ভ্রমণের উপায় ও খরচ
তাজিংডং নামের উৎপত্তি
তাজিংডং সংলগ্ন রেমাক্রী অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতীদের ভাষায় খুব বড় কোনো কিছু বোঝাতে ‘তাজিং’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। আর ‘ডং’ শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় পাহাড়কে। এভাবে ‘তাজিং’ ও ‘ডং’ শব্দ দুটি একত্রিত করে বিরাটকায় কোনো পাহাড় বোঝাতে ‘তাজিংডং’ নামের প্রচলন ঘটে। সরকারিভাবে এটি বিজয় নামেও পরিচিত।
বিজয় বা তাজিংডং ভ্রমণের সেরা সময়
বর্ষাকালে অন্য সব পাহাড়ি পথের মতো তাজিংডংও পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। এছাড়া শুধু শুষ্ক মৌসুমগুলোতেই চাঁন্দের গাড়ি করে পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছা যায়।
আর গরমের সময়গুলোতে এমন দুর্গম গিরিপথ বেয়ে ওঠা ঘর্মাক্ত কলেবরে কুলিয়ে ওঠা যায় না। তাই তাজিংডং আরোহণের সেরা সময় শীতের একদম শুরুর দিকে, যখন কুয়াশার চাদরে ঝিরিপথ অন্ধকার হয়ে যায় না। সেই সঙ্গে যদি পূর্ণিমা থাকে, তাহলে ভ্রমণ উচ্ছ্বাসের ষোলো আনাই পূরণ হয়।
আরও পড়ুন: মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় এবং আনুষঙ্গিক খরচ
ঢাকা থেকে তাজিংডং পৌঁছার উপায়
ঢাকাবাসীদের জন্য বান্দরবান যাওয়ার সেরা উপায় হলো বাসরুট। কেননা, এই পথে একমাত্র বাসেই রয়েছে সরাসরি বান্দরবান সদর পর্যন্ত যাওয়ার উপায়। বাস গাবতলী, কল্যাণপুর, কলাবাগান, মহাখালী, ফকিরাপুল বা যাত্রাবাড়ীর যে কোনো বাসস্ট্যান্ড থেকে বান্দরবানের বাস পাওয়া যায়।
বাস কোম্পানি এবং এসি ও ননএসি ভেদে এগুলোতে ভাড়া পড়তে পারে জনপ্রতি ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা।
ট্রেনে ভ্রমণ করতে হলে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম, তারপর চট্টগ্রাম থেকে লোকাল বাসে বান্দরবান। কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সারা দিন বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রামের ট্রেন পাওয়া যায়। এগুলোতে শ্রেণীভেদে ভাড়া পড়তে পারে মাথাপিছু ২৮৫ থেকে ৭৮৮ টাকা।
যাতায়াতের সময় বাঁচিয়ে আরও কম সময়ে যেতে চাইলে রয়েছে উড়োজাহাজে করে যাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথমে চট্টগ্রামেই নামতে হবে। আর এখানে সময় লাগবে মাত্র ১ ঘণ্টা। চট্টগ্রামগামী বিমানগুলোর টিকিট মূল্য পড়তে পারে জনপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ থেকে ১১ হাজার ১৭৫ টাকা পর্যন্ত। কমপক্ষে ১ মাস আগে থেকে টিকিট কাটলে খরচ আরও কমিয়ে আনা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: শীতকালে বাংলাদেশে ভ্রমণের জনপ্রিয় ১০ স্থান
চট্টগ্রামে পৌঁছে এখানকার বিআরটিসি টার্মিনাল বা দামপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়ায় পাওয়া যাবে বান্দরবানের বাস।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ৭৯ কিলোমিটার দূরত্বে থানচি উপজেলার অবস্থান। বান্দরবান থেকে বাসে কিংবা রিজার্ভ জিপ বা চাঁন্দের গাড়িতে করে থানচি যাওয়া যায়। বান্দরবানের থানচি বাসস্ট্যান্ডে প্রতি ঘণ্টায় পাওয়া যাবে থানচির লোকাল বাস। জনপ্রতি ২০০ টাকা ভাড়ায় এগুলো থানচি পৌঁছে দেয় ৪ থেকে ৫ ঘণ্টায়। চাঁন্দের গাড়িতে ১২ থেকে ১৪ জনের গ্রুপের জন্য খরচ পড়তে পারে ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকা। এই যাত্রাটা বেশ আনন্দের; তাছাড়া এভাবে যেতে সময়ও লাগে অনেক কম; প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা।
থানচি থেকেই শুরু হয় পায়ে হাটা যাত্রা। আগে অনেকে রুমা হয়ে তাজিংডং যেতো কিন্তু বর্তমানে রুমা থেকে শুধুমাত্র কেওক্রাডং পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। এছাড়া কোনোভাবে যেতে পারলেও জাদিপাই পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তাই এখন তাজিংডং চূড়ায় ওঠার একমাত্র উপায় থানচি হয়ে যাওয়া। এ রুটে হেডম্যানপাড়া হয়ে শেরকরপাড়া দিয়ে তাজিংডং পৌঁছাতে হয়।