গত ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার মুকেশ আম্বানিকে টপকে এশিয়ার শীর্ষ ধনকুবের সিংহাসনটি দখল করে নেন গৌতম আদানি। ২০১৫ সাল থেকে টানা ছয় বছর এশিয়ার শীর্ষ ধনীর অবস্থানটি ধরে রেখেছিলেন রিলায়েন্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই-পুত্র মুকেশ আম্বানি। ৪৮ বছরে গড়ে ওঠা এশিয়ার বিখ্যাত আটটি প্রধান কোম্পানির মালিক আম্বানি অন্তর্ভুক্ত আছেন বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ধনকুবেরদের সারিতেও। বিগত বছরগুলোতে সম্পদের দৌড়ে আম্বানির পিছু ধাওয়া করে আসছিলেন ৯টি কোম্পানির বহুজাতি ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি। তবে ২০২২ সালে এসে এশিয়ার এক নাম্বার ধনী হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি। চলুন সে ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেই।
আদানির এশিয়ার এক নাম্বার ধনী হওয়ার কারণ
২৭ জানুয়ারি শেয়ার বাজার বন্ধের ফলে তারতম্য দেখা দিতে শুরু করে রিলায়েন্স এবং আদানী গ্রুপের শেয়ারগুলোতে। মূলত এই কারণেই আদানির ধনীর তালিকার শীর্ষে উঠে আসা। প্রথম দিকে আম্বানির সম্পদের মূল্য ছিল ৯,১০০ কোটি ডলার যা প্রায় ৭ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকার সমান। অন্যদিকে গৌতম আদানির ক্ষেত্রে সেই অঙ্কটি ছিল ৮,৮৮০ কোটি ডলার বা প্রায় ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। পরে আম্বানি তাঁর সম্পদে ১,৪৩০ কোটি ডলার বা প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা যোগ করায় আদানিও নিজের সম্পদে অর্থ যোগ করেন। তবে তাঁর পরিমাণটা ছিলো অনেক বেশি- ৫,৫৫০ কোটি ডলার যা প্রায় ৪ লাখ সাড়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকার সমান।
স্বভাবতই এই দুই ভারতীয় শিল্পপতির সম্পদের তফাত প্রথমে প্রায় ২.৪ শতাংশ হলেও সমন্বিত পুঁজি বাজার অনুসারে মুকেশ আম্বানিকে ছাড়িয়ে যান গৌতম আদানি।
একদিকে যেমন আম্বানির রিলায়েন্সের শেয়ারের দাম পড়ে যায় ১.৭২ শতাংশ, অন্যদিকে আদানি গ্রুপের বিভিন্ন শেয়ারের দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
উল্লেখযোগ্য ভাবে আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ার দাম বাড়ে শতকরা ২.৩৪ ভাগ এবং আদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোনের শেয়ারের দাম শতকরা ৪ ভাগ বাড়ে। অপরদিকে রিলায়েন্সের শেয়ারে টানা তৃতীয় দিন ধরে ধ্বস নামলে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কমে দাড়ায় ১.৪৪ শতাংশতে।
আরও পড়ুন: রাজু ভাস্কর্যের সামনে নৃত্যরত ইরা: সপ্রতিভ উত্থানে এক বাংলাদেশি ব্যালেরিনা
বিগত অর্থ বছরে আদানি ট্রান্সমিশন-এর বৃদ্ধি ছিলো ২৮৮ শতাংশ। একই সময়ে আদানি টোটাল গ্যাস বেড়েছিলো ৩৫১.৪২ শতাংশ। পাশাপাশি আদানি পোর্টস, আদানি পাওয়ার, আদানি এন্টারপ্রাইজ, আদানি গ্রিন, আদানি টোটাল গ্যাস প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের মুখ দেখেছিল।
এভাবে সমন্বিত পুঁজি বাজারে সংস্থাগুলো মূলধন যোগ করায় শেয়ার বাজার বন্ধের ব্যাপারটি গৌতম আদানির জন্য পোয়াবারো হিসেবে কাজ করেছে।
আম্বানি-আদানির সম্পদের তুলনামূলক অবস্থান
আদানির বর্তমান সম্পদ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যে, যা প্রায় ৭৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার সমান। আর প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা দূরত্বে আম্বানির সম্পদের মূল্য হয়েছে ৮৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭৬ লাখ সাড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা।
অবশ্য ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০২১ এর নভেম্বরে। তখনকার হিসেব অনুসারে বিগত দুই বছরে প্রায় ১,৮০৮ শতাংশ বেড়েছিলো আদানির সম্পদ। ঠিক সে সময়ে আম্বানির সম্পদের বৃদ্ধি ছিলো মাত্র ২৫০ শতাংশ। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ফোর্বস-এর রিয়েলটাইম ডাটা নেটওয়ার্থ মতে গৌতম আদানি এখন বিশ্বের এগারতম ধনী ব্যক্তি।
আরও পড়ুন: ক্রেডিট কার্ড কীভাবে করবেন
নতুন বিনিয়োগে আদানি বনাম আম্বানি
সম্পদের প্রতিযোগিতার ফলাফল উপেক্ষা করে সমান উদ্যমে চলছে আদানি ও আম্বানির বিনিয়োগের ধারা। আম্বানির রিলায়্যান্স গুজরাট ভিত্তিক বিশাল বিনিয়োগ করতে চলেছে। ইতোমধ্যে সেখানে মোট ৫ দশমিক ৯৫ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে জায়ান্ট গ্রুপটি। তারা ৫ লাখ কোটি রুপির নিশ্চয়তা দিয়েছে হাইড্রোজেন শক্তি উৎপাদন এবং ১০০ গিগাওয়াটের অপ্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থা নির্মাণকল্পে। এজন্য শিঘ্রই শুরু হবে জমি দেখা। তাছাড়া ব্যাটারি স্টোরেজ ও সৌরবিদ্যুৎ সহ আরো চারটি কারখানা স্থাপনের জন্য বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ ঠিক হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি রুপি। বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে আম্বানির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর আওতাভুক্ত ব্যবসাগুলোতে।
অপরদিকে আম্বানির দেখানো পথে গুজরাট কেন্দ্রিক অর্থ বিনিয়োগ চলছে আদানি গ্রুপেরও। তাদের প্রধান ক্ষেত্র ছিলো বন্দর কেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চলগুলো। তবে এবার তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাতে। পস্কো’র সাথে করা সাম্প্রতিক চুক্তিটি তারই প্রমাণ। দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিটির সাথে রিনিউএবল এনার্জি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য চুক্তিটি সম্পাদন করেছে আদানি ইস্পাত। এই বিনিয়োগকৃত অঙ্কের সম্ভাব্য অর্থ প্রায় ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি রুপি। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল।
আরও পড়ুন: ট্রেড লাইসেন্স করার পদ্ধতি: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, খরচ ও সময়
আম্বানি ও আদানির আয়ের প্রধান উৎস
গৌতম আদানির আয়ের সিংগভাগ আসে তাঁর নিজের গড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ থেকে। এই বহুজাতি গ্রুপটিতে অন্তর্ভুক্ত আছে বন্দর ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিক বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ, বিমানবন্দর অপারেশন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, প্রাকৃতিক গ্যাস, এবং অবকাঠামো তৈরির মত ব্যবসায়িক ক্ষেত্রগুলো।
অন্যদিকে মুকেশ আম্বানির আয়ের প্রধান উৎস আম্বানি পরিবারের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এর অধিভুক্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রবিন্দু হলো শক্তি, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোকেমিক্যাল, গণমাধ্যম, এয়ারপোর্ট, টেক্সটাইল এবং টেলিযোগাযোগ।
শেষাংশ
মুকেশ আম্বানি ও গৌতম আদানি; দুই বিলিয়নেয়ারই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। আম্বানি খুচরো পণ্যজাত এবং টেলিকমের মতো ডাটা-চালিত ভোক্তা ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছিলেন, যেখানে অবকাঠামো এবং ইউটিলিটিগুলোতে মনোনিবেশ করেছিলেন আদানি। অবশ্য এনার্জি নিয়ে ব্যবসা ক্ষেত্রতে তাদের দুজনেরই অবদান থাকছে। ৫৫ বছর বয়সী আদানি এখন অধৈর্য্য হয়ে তার সফল বন্দর কেন্দ্রিক গন্ডির বাইরে যেয়ে উপার্জনকে বৈচিত্র্যময় করতে ব্যস্ত। কিন্তু ৬৪ বছর বয়সী আম্বানি এখন তাঁর রাজ্যের উত্তরাধীকারদের দিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন।