চায়ের আদি নিবাস চীন। হাজার হাজার বছর ধরে, চা চীনা সংস্কৃতির অনুষঙ্গ এবং চীনের জনগণের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এটা বিশ্বাস করা হয় যে চা সংস্কৃতি তাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭) সময় চীন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। অষ্টম শতাব্দীতে ট্যাং পণ্ডিত লু ইউ’র লেখা ‘দ্য ক্লাসিক অব টি’ চীনের প্রথম গ্রন্থ, যেখানে চা এবং এর সম্পর্কিত জ্ঞান ও গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

উত্তর-পশ্চিম চীনের শানসি প্রদেশের ফামেন মন্দির একসময় তাং রাজবংশের রাজকীয় মন্দির ছিল। ১৯৮৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মন্দিরের ভূগর্ভস্থ প্রাসাদ থেকে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম এবং সর্বোচ্চ র‌্যাঙ্কিং ট্যাং ইম্পেরিয়াল চা সেটটি আবিষ্কার করেন।

ফ্যামেন টেম্পল মিউজিয়ামের গবেষক জিয়াং জি বলেন, ‘এখানে পাওয়া চায়ের সেটটি চীনা চা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য।’

জিয়াং বলেন,‘রাজ পরিবারও বলিদান ও টোস্টিং এর জন্য চা ব্যবহার করতে শুরু করে এবং তাং রাজবংশে চা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।’

গানের রাজবংশে (৯৬০-১২৭৯) চা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে যখন বিশেষ চা-টেস্টিং ক্লাবগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে চা প্রতিযোগিতার ফ্যাশন আসে।

ইতিহাস জুড়ে, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম এবং অন্যান্য উপায়ে চা চীনা ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিতে গভীরভাবে মিশে আছে।

আজও চা চীনা জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন ধরনের চা পরিবেশন করা হয়।

চীনা প্রবাদ হিসেবে, ‘আগুন কাঠ, চাল, তেল, লবণ, সস, ভিনেগার ও চা’ প্রতিটি পরিবারের দৈনিক প্রয়োজনীয় সাতটি জিনিস।

চা সামাজিকীকরণ এবং বিয়ে ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো এবং চা-সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পরিবার ও প্রতিবেশিদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়।

চীনের চা উৎপাদনকারীরা চায়ের ছয়টি বিভাগ তৈরি করেছে: সবুজ, হলুদ, গাঢ়, সাদা, ওলং ও কালো চা। চীনে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত চায়ের সঙ্গে ব্যবহার করার মতো ২ হাজারের বেশি পণ্য রয়েছে। যেমন- ফুলের সুগন্ধযুক্ত চা।

আরও পড়ুন: খাদ্যতালিকায় ৫ খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখবে ডায়াবেটিস

চায়না টি মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে চীনের মোট দেশীয় চা বিক্রি ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন এবং ৩০০ বিলিয়ন ইউয়ান (৪২ বিলিয়ন ইউএস ডলার) ছাড়িয়েছে।

চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিলুপ্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগের পরিচালক ওয়াং চেনয়াং বলেছেন, বর্তমানে, ৪০ টিরও বেশি ভোকেশনাল স্কুল এবং ৮০ টিরও বেশি কলেজ চা ও চা সংস্কৃতি-সংশ্লিষ্ট বিভাগ চালু করেছে। প্রতি বছর এসব বিভাগে ৩ হাজারেরও বেশি মানুষকে চা তৈরি এবং চা শিল্পে পেশাদার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

যদিও চায়ের ঐতিহ্য প্রাচীন চীনাদের দ্বারা উদ্ভূত, তবে নতুন নতুন ফ্লেভারের উদ্ভাবন চা শিল্পে নতুন প্রাণ সঞ্চালন করেছে।

গত কয়েক দশক ধরে দুধ চা, বিশেষ করে বাবল দুধ চা, তরুণ চীনাদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় পানীয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ‘নতুন ফ্লেভারের চা পানীয়’ পান বৃদ্ধি পেয়েছে। যা তৈরি করা হয় চা, তাজা ফল ও শাকসবজির মিশ্রণে তৈরি হয় এবং কখনও কখনও দুগ্ধজাত পণ্য বা জুস দিয়ে সজ্জিত করা হয়। বিশেষত তরুণদের মধ্যে এই চা বেশি জনপ্রিয়।

আইমিডিয়া রিসার্চের তথ্য অনুসারে, চীনের চা-ভিত্তিক পানীয়ের বাজার স্কেল ২০২১ সালে ২৭৯ বিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়েছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ৩৭৫ বিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, চা চীন এবং বিশ্বের সঙ্গে সংযোগকারী সেতু। এটি এক সময় প্রাচীন সিল্ক রোড এবং প্রাচীন চা হর্স রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ছিল এবং আজ, চীন বিশ্বের একটি প্রধান চা রপ্তানিকারক।

আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে দামি ১০টি খাবার

মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) চীনের ঐতিহ্যবাহী চা তৈরি জাতিসংঘের শিক্ষাগত, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেস্কো) বিলুপ্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। যা চীনের চা সংস্কৃতির বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির জন্য একটি মাইলফলক।

ওয়াং চেনিয়াং বলেন, ‘ইউনেস্কোর বিলুপ্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় সফলভাবে অন্তর্ভুক্তি মানব সভ্যতার বৈচিত্র্যের জন্য চীনের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে তুলে ধরেছে।’

বেইজিং নর্মাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জিয়াও ফাং বলেন, ‘চীনা মানুষ বিশ্বাস করে যে চা শালীনতা, সম্প্রীতি, সহানুভূতি ও সম্মানের মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সদ্য স্বীকৃত বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এই ধরনের চীনা জ্ঞান ও দর্শন বিশ্বের আরও বেশি মানুষের কাছে পরিচিত করতে সাহায্য করবে।’

আরও পড়ুন: কদবেলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা