মানুষ যদি হতে চাও কর মানুষের ভজন, স্বাধীন বাংলা স্বাধীন হবে, সুখে রবে বাংলা মায়ের সন্তান, কোন মেস্তোরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়, কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি, জ্ঞানী-গুণী সবাই বলেন মুক্তি আসে মানবতায়-এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের রচয়িতা বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম।
হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের কালনী নদী ঘেষা উজান ধল গ্রামে বাউল সম্রাটের ১০৬ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুরু হয়েছে দু’দিনব্যাপী লোক উৎসব।
মঙ্গলবার রাত ৯টা থেকে শুরু হয়ে বুধবার সারারাত পর্যন্ত চলবে এই লোক উৎসব। দেশ-বিদেশের বাউল প্রেমী শাহ আব্দুল করিমের ভক্তদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে উজান ধল গ্রামটি। গ্রামের মাঠের চতুর্দিকে শতাধিক দোকানী বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী নিয়ে বসেছে মেলা। শিশুদের বিনোদনের জন্য রাখা হয়েছে দোলনা ও হরেক রকমের পণ্যসামগ্রী। রাতে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বাউল শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।
মেলার নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
শাহ আব্দুল করিম পরিষদ ও ধল গ্রামবাসীর উদ্যোগে দু’দিন ব্যাপী গ্রামের মাঠে প্রতিবছরের মতো এবারও লোক উৎসব উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। শাহ আব্দুল করিম পরিষদের সভাপতি ও আব্দুল করিমের ছেলে শাহ নূর জালালের সভাপতিত্বে এবং আপেল মাহমুদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় এই দু’দিনব্যাপী লোক উৎসবের উদ্বোধন করেন দিরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদুর রহমান মামুন। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরী। সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামাল আহমদ, দিরাই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোহন চৌধুরী,তাড়ল ইউপি চেয়ারম্যান মো.আলী আহমদ, কুলজ্ঞ ইউপি চেয়ারম্যান একরার হোসেন, বিশ্বনাথ উপজেলা আব্দুল করিম পরিষদের সভাপতি মো.আব্দুল হাই, বাউল শিল্পী আব্দুর রহমান, বাউল সিরাজ উদ্দিন প্রমুখ।
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দিরাইয়ের উজান ধল গ্রামের এক গরীব বাবার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন করিম। তিনি তার জীবদ্দশায় দুই হাজারের মতো গান রচনা করেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাখাল রাজা হয়ে তার দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা আর মেধা দিয়ে তিনি অজোপাড়া গায়ের গোচারণ ভূমিতে বসে বসে অসংখ্য কালজয়ী গান রচনা করেছেন। ক্রমান্বয়ে তার গান বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।পরবর্তীতে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এই বাউল সম্রাট।
এ ব্যাপারে শাহ আব্দুল করিমের ছেলে নূর জালাল জানান, অন্য বছরগুলোতে কোনো কোনো প্রতিস্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা করলেও এবার কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে আমার বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে আমাদের গ্রামবাসীর সহযোগিতায় সাধ্যমতো এবারো লোক উৎসব করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি পৃষ্টপোষকতা পেলে আমার বাবার গানগুলো বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে এখানে একটি সঙ্গীতালয় স্থাপন করা জরুরি। সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপন করা গেলে নতুন প্রজন্মের অনেক নতুন শিল্পী তৈরি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এ ব্যাপারে তাড়ল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলী আহমদ বলেন, এই হাওরপাড়ের মানুষ শাহ আব্দুল করিমের মাধ্যমেই আমাদের সুনামগঞ্জ তথা দিরাইবাসীকে লোকজন চিনেন। দেশের বিভিন্ন জায়গাতে গেলে দিরাই পরিচয় দিলেই বলেন ও তাহলে আপনারা তো করিমের এলাকার লোকজন। আব্দুল করিম আমাদের অনুপ্রেরণা। তাই করিমের গান সংরক্ষণ করা গেলে যেমন নতুন অনেক শিল্পী তৈরি হবে, তেমনি করিম আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন।
চেয়ারম্যান মো. আলী আহমদ ধলবাজার থেকে শাহ আব্দুল করিমের গ্রামের বাড়ি উজান ধল পর্যন্ত রাস্তাটি সংস্কারের দাবি জানান সরকারের কাছে।
এ ব্যাপারে দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরী জানান, সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে দিরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদুর রহমান মামুন বলেন, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম একজন রাখাল রাজা ছিলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে বুকে ধারণ করে বাউল গানে উৎসাহিত হন। বিশ্বমণ্ডলে একজন খ্যাতিমান গায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমেই তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।
আগামীতে শাহ আব্দুল করিমের এই জন্মবার্ষিকীতে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় একটি সঙ্গীতালয় স্থাপনে সহযোগিতার দাবি তার ভক্তদের।