চিংড়ির বিশ্ব বাজারের ৮০ শতাংশ স্থান দখলে থাকা ‘ভেনামি’ প্রজাতির চিংড়ির ‘বাণিজ্যিক’ চাষের অনুমতি না থাকায় বিশাল এই বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। শুধুমাত্র পাইলট উৎপাদনের অনুমতির কারণে চাষি-উৎপাদনকারী-রপ্তানিকারকরা ব্যাংকের ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন না। ফলে তারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এ খাতে বিনিয়োগও করতে পারছেন না। এ অবস্থায় ‘পাইলট’র স্থলে ভেনামি চিংড়ির ‘বাণিজ্যিক’ উৎপাদনের অনুমতি চেয়েছেন চিংড়ি রপ্তানিকারকরা।
রবিবার নগরীর শ্রিম্প টাওয়ারে অনুষ্ঠিত ‘চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে বাগদা চিংড়ির পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষের আবশ্যকতা’ শীর্ষক সেমিনারে এ দাবি তোলা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ফিশারী প্রডাক্টস বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে সঞ্চালনা ও সভাপতিত্ব করেন বিএফএফইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এস. হুমায়ুন কবির। প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাদিকুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল, বিএফএফইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এম. খলিলুল্ল্যাহ, প্রেস ক্লাব সভাপতি এসএম নজরুল ইসলাম ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ফারুক আহমেদ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর খুলনার সাবেক উপ-পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার।
সেমিনারে বলা হয়, চিংড়ি চাষি ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম খাত চিংড়ি শিল্পকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ‘ভেনামি’ চাষের কোনো বিকল্প নেই।
একমাত্র ‘ভেনামি’ই পারে দেশের চিংড়ি শিল্পের সম্প্রসারণ করে বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে। দ্রুত একটি সহজ নীতির মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে ‘ভেনামি’ চিংড়ি চাষকে উন্মুক্ত করে রপ্তানির পদক্ষেপ নিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
সেমিনারে আরও বলা হয়, বাগদা ও গলদা চিংড়ির উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এ কারণে ইতোমধ্যে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি শিল্পে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ব বাজারে ভেনামি চিংড়ির দাম কমের পাশাপাশি পর্যাপ্ত চাহিদা থাকায় দেশের রপ্তানিকারকরা বাজার ধরে রাখতে পারছে না।
সে কারণে আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বিগত প্রায় ২০ বছর ধরে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতির জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে।
যার ফলে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই জাতের চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয় সরকার। অনুমোদনপ্রাপ্ত যশোর বিসিক শিল্প নগরের ‘এম ইউ সী ফুডস’ ও সাতক্ষীরার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সুশীলন’ যৌথ উদ্যোগে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে খুলনার পাইকগাছা লোনা পানি কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। যার গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৯ টনের বেশি।
এদিকে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ির গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৪১ কেজি। সেখানে প্রতিবেশি দেশ ভারতে ‘ভেনামি’ চিংড়ির হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন সাত হাজার ১০২ কেজি। অর্থ্যাৎ বাগদার তুলনায় ‘ভেনামি’র উৎপাদন হেক্টর প্রতি ছয় হাজার ৭৬১ কেজি বেশি। যার প্রমাণ মিলেছে খুলনায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষকৃত ‘ভেনামি’র উৎপাদনে।
সেমিনারে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস. হুমায়ুন কবীর বলেন, কাঁচামালের (চিংড়ি) অভাবে ইতোমধ্যেই দেশের ১০৫টি হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনোরকমে চালু আছে মাত্র ২৮টি। বাকি ৭৭টিই বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়টি চালু আছে, তাতে দেশে উৎপাদিত চিংড়িতে সক্ষমতা ও ধারণ ক্ষমতার মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ চাহিদা মিটছে। ফলে প্রক্রিয়াজাত খরচও বেশি হচ্ছে।
এ অবস্থায় রপ্তানির এ খাতটি ‘খাদের কিনারে’ এসে দাঁড়িয়েছে। এ শিল্পকে মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়াতে হলে ভেনামি চাষ করে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, এশিয়া মহাদেশের একমাত্র ‘বাংলাদেশ’ বাদে বাকি ১৪টি দেশেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে ভেনামি। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে এ প্রজাতির চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে ‘পাইলট’র স্থলে ভেনামি চিংড়ির ‘বাণিজ্যিক’ উৎপাদনের অনুমতি দাবি করেন তিনি।
আরও পড়ুন: চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি সমস্যা সমাধানে সরকার বদ্ধপরিকর: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী