বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের অফিস কক্ষে এ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিন। এ সময় তদন্ত কমিটির অন্যান্য সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক শহীদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি।
গত ৩০ অক্টোবর লালমনিরহাট অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন কার্যদিবস সময় দিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে কয়েক দফায় সময় নিয়ে বুধবার তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে কমিটি।
সংবাদ সম্মেলনে এ তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিন জানান, তিন কার্যদিবস থেকে সময় বাড়িয়ে ৯ কার্যদিবস সময় নেয়া হয়। সময় মতো তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসক অফিসের বাইরে থাকায় বৃহস্পতিবার সকালে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। এটি একটি গুজব। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও লাশ পোড়ানো হয়েছে।
তিনি জানান, তদন্ত কার্যে মোট ৫০ জনের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য নিয়ে তদন্ত কমিটির সাতটি সভা করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। ছয়টি অধ্যায়ে ৪২টি অনুচ্ছেদে ৭৩ পাতা সংযুক্তিতে মোট ৬ পাতার তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়। ঘটনার ভূমিকা, বিবরণ, অধিক তথ্যানুসন্ধান, গভীর পর্যবেক্ষণ, সুপারিশমালা ও মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে এবং প্রতিবেদনটিতে চারটি সুপারিশ স্থান পেয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক সাইদুল ইসলাম জানান, বিচার কার্যের তদন্তকারী সংস্থা আইনি জটিলতা নিরসনে প্রয়োজন মনে করলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রতিবেদনটি নিতে পারবেন।
তদন্ত কমিটির অপর সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার গভীরে যেতে এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ১৭-২০টি ভিডিও ক্লিপ সংগ্রহ করেছি। এসব দেখেও অনেক তথ্য উপাত্ত পেয়েছি।’
গত ২৯ অক্টোবর বিকালে পাটগ্রাম উপজেলায় শহিদুন্নবী জুয়েলকে (৪৮) পিটিয়ে হত্যার পর লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক লাইব্রেরিয়ান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।
পুলিশ জানায়, শহিদুন্নবী জুয়েল ঘটনার দিন বিকালে সুলতান রুবায়াত সুমন নামে একজনকে সাথে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকালে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরীফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ে পড়ে যায়। এ সময় কোরআন ও হাদিস বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সাথে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান। সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। এ সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে লাশ টেনে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় স্থানীয়রা। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।
এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন।