ই-পাসপোর্ট প্রক্রিয়াকরণকে আরও নিরবচ্ছিন্ন ও সাবলীল করতেই অবতারণা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকারি পরিষেবা থাকায় সমূহ ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হতো আবেদন জমা দেওয়ার সময়। বর্তমানে জনসংখ্যার ঘনত্বের ভিত্তিতে বিভাগীয় অফিসগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণে উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসছে আবেদনকারীদের দীর্ঘ লাইন। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে স্থাপন করা হয়েছে একাধিক কার্যালয়। তাই চলুন, আঞ্চলিক পর্যায়ের পাসপোর্ট অফিস থেকে ই-পাসপোর্ট করার নিয়ম জেনে নেওয়া যাক।

ই-পাসপোর্ট আবেদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

জাতীয় পরিচয়পত্র ও অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ

·   ১৮ বছরের নিচের প্রার্থীর জন্য অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ

·   ১৮ থেকে ২০ বছরের প্রার্থীর জন্য এনআইডি (জাতীয় ‍পরিচয়পত্র) কার্ড অথবা অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদের যে কোনো একটি

·   ২০ বছরের বেশি প্রার্থীর ক্ষেত্রে এনআইডি কার্ড

·   শিশুদের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার এনআইডি কার্ড

আরো পড়ুন: ট্রেড লাইসেন্স করার পদ্ধতি: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, খরচ ও সময়

পেশাগত প্রমাণপত্র

·   ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ও ড্রাইভারের মতো প্রযুক্তিগত বা কারিগরি পেশার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক কারিগরি সনদগুলো

·   শিক্ষার্থী হলে,

o  প্রার্থীর সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ

o  অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দেওয়া প্রত্যয়নপত্র

o  কিংবা স্টুডেন্ট আইডি কার্ড

·   বেসরকারি চাকরিজীবী হলে কর্মরত প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া আনুষ্ঠানিক প্রত্যয়নপত্র

·   সরকারি চাকরিজীবি হলে নিম্নলিখিত নথির যে কোনো একটি (ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ওয়েবসাইটে নোটিশ আকারে প্রকাশিত থাকতে হবে):

o  সরকারি আদেশ (জিও)

o  বা, অনাপত্তি পত্র (এনওসি)

o  বা, প্রত্যয়নপত্র

o  বা, অবসরোত্তর ছুটির আদেশ (পিআরএল অর্ডার)

o  বা, পেনশন বই আপলোড/সংযোজন করতে হবে

·   কৃষক বা ক্ষেতে কৃষিকাজে নিযুক্ত থাকলে জমির পর্চার অনুলিপি

·   ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সের অনুলিপি

·   বসবাসরত ঠিকানার প্রমাণপত্র হিসেবে সাম্প্রতিক ইউটিলিটি (বিদ্যুৎ বা গ্যাস অথবা পানি) বিল

এই নথিগুলোর কোনো সত্যায়নের প্রয়োজন নেই। সেই সাথে আবেদন ফর্মে প্রার্থীর কোনো ছবি যুক্ত করারও দরকার নেই।

আরো পড়ুন: স্মার্ট আইডি কার্ড: জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকলে যেভাবে সংশোধন করবেন

আবেদন জমাদানের সময় উপরোক্ত কাগজপত্রের সাথে অতিরিক্ত যা যা নিতে হবে:

·   বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্টসহ আবেদনপত্রের সারাংশের প্রিন্ট কপি

·   অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ফর্ম বা পূর্ণ আবেদনপত্রের প্রিন্ট কপি  

·   পাসপোর্ট ফি পরিশোধের রশিদ

·   ৬ বছরের কম বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক গ্রে ব্যাকগ্রাউন্ডে তোলা ল্যাব প্রিন্টকৃত পাসপোর্ট সাইজের ছবি

আরও পড়ুন: শিশুদের ই-পাসপোর্টের নিয়ম: কীভাবে আপনার অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পাসপোর্ট করবেন

ধাপে ধাপে ই-পাসপোর্ট আবেদনের নিয়ম

আঞ্চলিক ই-পাসপোর্ট কার্যালয় নির্ধারণ

প্রতিটি বিভাগের অধীনে যে অফিসগুলোতে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম অব্যাহত আছে, সেগুলো হলো-

ঢাকা

বাংলাদেশ সচিবালয় (ঢাকা), ঢাকা সেনানিবাস, কেরাণীগঞ্জ (ঢাকা), উত্তরা (ঢাকা), নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ।

চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি।

খুলনা

যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নড়াইল, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ও ঝিনাইদহ।

রংপুর

লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম।

রাজশাহী

নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

বরিশাল

ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনা।

ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর ও জামালপুর।

সিলেট

সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট করার নিয়ম: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও খরচ

আঞ্চলিক ই-পাসপোর্ট অফিস এবং সেগুলোর অধীনস্থ থানাগুলো

কেরাণীগঞ্জ (ঢাকা)

নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ মডেল, কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ, বংশাল, শ্যামপুর, কদমতলী, গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, দোহার, কোতোয়ালী, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর, চকবাজার, ওয়ারী ও ডেমরা।

উত্তরা (ঢাকা)

উত্তরখান, উত্তরা পূর্ব, বিমানবন্দর, উত্তরা পশ্চিম, দক্ষিণখান, তুরাগ, আশুলিয়া, পল্লবী, খিলখেত, ভাসানটেক ও ভাটারা।

ঢাকা পশ্চিম (মোহাম্মদপুর)

মোহাম্মদপুর, সাভার, হাজারীবাগ, ধামরাই, আদাবর, শাহ আলী, নিউমার্কেট ও দারুস-সালাম।

ঢাকা পূর্ব (আফতাবনগর)

খিলগাঁও, মতিঝিল, মুগদা, সবুজবাগ, পল্টন, রামপুরা, শাহজাহানপুর, বাড্ডা ও হাতিরঝিল।

সেনানিবাস

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট

সচিবালয়

বাংলাদেশ সচিবালয় 

চট্টগ্রাম সদর

চাঁদগাঁও, কর্ণফুলী, বাঁশখালী, লোহাগড়া, চকবাজার, সাতকানিয়া, বাকুলিয়া, চান্দনাইশ, কোতোয়ালী, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, পটিয়া ও পাঁচলাইশ।

অন্যান্য আঞ্চলিক কার্যালয়

উপরোল্লিখিত প্রতিটি জেলায় ১টি করে।

আরো পড়ুন: পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে করণীয়

অনলাইনে ই-পাসপোর্টের আবেদন ফর্ম পূরণ করবেন যেভাবে

প্রথমে ই-পাসপোর্ট অনলাইন রেজিস্ট্রেশন পোর্টালে (www.epassport.gov.bd) যেয়ে ‘অ্যাপ্লাই অনলাইন’ ট্যাবে যেতে হবে। ট্যাবটি নতুন যে পেজে নিয়ে যাবে, সেখানে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম অব্যাহত থাকা অফিসের অবস্থান শনাক্ত করতে হবে। স্ক্রিনে প্রদর্শিত ড্রপ ডাউন লিস্ট থেকে জেলা ও থানার নাম বাছাই করার সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অধিভুক্ত ই-পাসপোর্ট কার্যালয়ের নামটি দেখাবে।

এরপর ই-মেইল ঠিকানা, এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধন ও মোবাইল নাম্বার দিয়ে পোর্টালটিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরবর্তী লগইন করে ই-পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে হবে।

ফর্মের প্রতিটি তথ্য এনআইডি অনুসারে নির্ভুলভাবে দিতে হবে। এরপর অনলাইনে পাসপোর্ট ফি প্রদানের অপশন আসবে। ফি অনলাইনে পরিশোধ করা হলে পরিশোধের মাধ্যম ও রশিদ নাম্বার স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যাবে। 

অতঃপর বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেট করার পেজ আসবে। এখানে প্রদর্শিত তারিখগুলো থেকে পছন্দমতো একটি তারিখ বাছাই করা হলে তা অ্যাপয়েন্টমেন্ট হিসেবে সেট হয়ে যাবে।

সবশেষে চূড়ান্তভাবে আবেদন সাবমিটের পর এই অ্যাপয়েন্টমেন্টসহ অ্যাপ্লিকেশন সামারি তৈরি হবে। এই সামারি ও সাবমিটকৃত পুরো অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ফর্মটি প্রিন্ট করে সংরক্ষণ করতে হবে।

আরো পড়ুন: ২০২৪ সালে ভিসা ছাড়াই যেসব দেশে যেতে পারবেন বাংলাদেশিরা

ই-পাসপোর্টের ফি পরিশোধ করবেন যেভাবে

অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল পরিশোধ ব্যবস্থাগুলো ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অনলাইনে ই-পাসপোর্ট ফি দেওয়া যাবে। এই পেমেন্টের জন্য স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান ও মাধ্যমগুলোর বিস্তারিত https://www.epassport.gov.bd/instructions/passport-fees-এই লিংকে পাওয়া যাবে।

এছাড়া অফলাইনে এ-চালানের মাধ্যমে দেশের যে কোনো সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক থেকে ফি পরিশোধ করা যাবে।

ই-পাসপোর্ট ফি

পাসপোর্টের মেয়াদ, পাসপোর্ট বইয়ের পৃষ্ঠা এবং বিতরণের পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে ফি বিভিন্ন রকম। প্রধানত নিয়মিত, জরুরি এবং অতীব জরুরি- এই তিন উপায়ে ই-পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়।

নিয়মিত ক্যাটাগরিতে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের তারিখ থেকে ১৫ কার্যদিবস বা ২১ দিনের মধ্যে ই-পাসপোর্ট দেওয়া হয়। জরুরি ক্যাটাগরিতে প্রক্রিয়াকরণের সময়কাল বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের দিন থেকে ৭ কার্যদিবস কিংবা ১০ দিন। অতীব জরুরির ক্ষেত্রে এই সময়সীমাটি বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের তারিখ থেকে ২ কার্যদিবস।

আরো পড়ুন: পুরাতন পাসপোর্ট নবায়নের উপায়

৫ বছর মেয়াদী ৪৮ পৃষ্ঠার ই-পাসপোর্ট

·   নিয়মিত: ৪ হাজার ২৫ টাকা

·   জরুরি: ৬ হাজার ৩২৫ টাকা 

·   অতীব জরুরি: ৮ হাজার ৬২৫ টাকা 

৫ বছর মেয়াদী ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট

·   নিয়মিত: ৬ হাজার ৩২৫ টাকা

·   জরুরি: ৮ হাজার ৬২৫ টাকা

·   অতীব জরুরি: ১২ হাজার ৭৫ টাকা

১০ বছর মেয়াদী ৪৮ পৃষ্ঠার ই-পাসপোর্ট

·   নিয়মিত: ৫ হাজার ৭৫০ টাকা

·   জরুরি: ৮ হাজার ৫০ টাকা

·   অতীব জরুরি: ১০ হাজার ৩৫০ টাকা

১০ বছর মেয়াদী ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট

·   নিয়মিত: ৮ হাজার ৫০ টাকা

·   জরুরি: ১০ হাজার ৩৫০ টাকা

·   অতীব জরুরি: ১৩ হাজার ৮০০ টাকা

আরো পড়ুন: অনলাইনে ই-পাসপোর্ট আবেদনে ভুল হলে সংশোধনের নিয়ম

আবেদন পত্রসহ নথিপত্র জমা ও বায়োমেট্রিক নিবন্ধন

অনলাইনে পূরণকৃত আবেদন পত্রসহ প্রয়োজনীয় সব নথি নিয়ে পূর্বনির্ধারিত দিনে চলে যেতে হবে নির্ধারিত পাসপোর্ট কার্যালয়ে। এই দিনে প্রার্থীর ছবি তোলা হবে এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হবে। সব কাজ শেষে একটি ডেলিভারি স্লিপ দেওয়া হবে, যেটি ই-পাসপোর্ট সংগ্রহের দিন সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে।

ই-পাসপোর্ট সংগ্রহ

ই-পাসপোর্ট তৈরি হয়ে গেলে তা সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ আবেদন পত্রে প্রদানকৃত প্রার্থীর মোবাইল নাম্বার ও ই-মেইল ঠিকানায় তা জানানো হবে। অতঃপর সেই তারিখে ই-পাসপোর্ট সংগ্রহের জন্য পাসপোর্ট কার্যালয়ে উপস্থিত হতে হবে। এ সময় ডেলিভারি স্লিপের সঙ্গে প্রার্থীর এনআইডি কার্ডও নিয়ে আসতে হবে।

শেষাংশ

ই-পাসপোর্ট আবেদন গ্রহণের এই কার্যকরী ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখতে নাগরিকদেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রত্যেক আবেদনকারীকে তার নিজ নিজ থানার জন্য নির্ধারিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ই-পাসপোর্টের আবেদন দাখিল করা আবশ্যক। অবশ্য অনলাইনে আবেদন করার সময় থানা বাছাইয়ের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অধিভুক্ত অঞ্চলটি দেখায়। এক্ষেত্রে প্রার্থীকে শুধু কার্যালয়ের ঠিকানাটি সরেজমিনে খুঁজে বের করতে হবে। সর্বোপরি, ই-পাসপোর্ট পরিষেবার এই বিকেন্দ্রীকরণ প্রার্থী এবং কর্মকর্তা উভয়ের জন্যই পুরো প্রক্রিয়াকে আরও সহজতর করেছে।

আরো পড়ুন: ই-পাসপোর্টে ভুল তথ্য সংশোধন পদ্ধতি