বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা হলো কুতুবদিয়া। প্রায় ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপ।
এপ্রিল মাস থেকে ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুতুবদিয়া দ্বীপের প্রায় ২ লাখ মানুষের জীবনধারা অনেক বদলে গেছে।
যে দ্বীপটি সন্ধ্যার সময় অন্ধকারে ডুবে যেত, সেখানে এখন ঝলমলে বিদ্যুতের আলো রয়েছে। এপ্রিল মাস থেকে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে দ্বীপবাসী বিদ্যুৎ সংযোগ সুবিধা পাচ্ছেন।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ পাঁচ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণ করে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে কুতুবদিয়ায় প্রায় ২ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সম্প্রতি দ্বীপে গিয়ে কুতুবদিয়ার ঘর-বাড়িতে আলোকসজ্জা দেখা গেছে। বিদ্যুতের কারণে ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও হচ্ছে।
স্থানীয় কিশোর রফিক, সেলিম ও আজিজুল এর আগে কখনো আইসক্রিম খায়নি।
কৃষক মনজুর আলমের একটি মোবাইল ফোন ছিল, কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় সেটি চার্জ দিতে পারতেন না।
বিদ্যুৎ-আসায় বর্তমানে কুতুবদিয়ার মানুষের জীবনধারা ‘বিদ্যুতের গতিতে’ বদলে গেছে।
এমনকি কয়েক মাস আগেও সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ঝুঁকি নিয়ে গর্ভবতী নারীদের নিয়ে যাওয়া হতো চকরিয়া বা কক্সবাজারে। কিন্তু এখন আর সাগর পাড়ি দিতে হবে না।
দ্বীপে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার পর ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালে একটি অপারেশন থিয়েটার চালু করা হয়েছে।
এছাড়া লবণ চাষ কুতুবদিয়া উপজেলায় একটি সাধারণ কাজ। এখানে রয়েছে একটি বাতিঘর, সমুদ্র সৈকত এবং কুতুব আউলিয়ার মাজার।
আরও রয়েছে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। যেখান থেকে অবিশ্বাস্য সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
এছাড়া এই দ্বীপের আরেকটি আকর্ষণ হল সি-গাল।
কুতুবদিয়ার বাসিন্দারা জানান, আগে দ্বীপটি আর্থ-সামাজিক অবস্থার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। আধুনিক কৃষি শিক্ষা বা চিকিৎসা সেবার কোনো সুযোগ ছিল না।
তারা জানান, সরকার দ্বীপে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থা করেছে। কুতুবদিয়াবাসী এখন বুঝতে পারছেন বিদ্যুৎ কতটা জরুরি।
এছাড়া শিল্প, কোল্ড স্টোরেজ, ব্যবসাসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এদিকে রাস্তার আলো যাতায়াতের পথকে সহজ করে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
তারা আরও জানান, দ্বীপে উৎপাদিত মাছ, শুকনো ফল, লবণ, তরমুজ, সুপারিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হচ্ছে। দ্বীপবাসী আশা করছে পর্যটনের দ্রুত প্রসার ঘটবে।
হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপের জন্য একটি ১০০ শতাংশ নির্ভরযোগ্য এবং টেকসই বিদ্যুতায়ন প্রকল্প। যা ২০২০ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাতে নেওয়া হয়েছিল।
এদিকে চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই কুতুবদিয়া দ্বীপে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।
আরও পড়ুন: জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলো মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট-১
মনোয়ারখালী গ্রামের কৃষক মনজুর আলম বলেন, আগে তেল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে মোবাইল চার্জ দিতাম। তেল না থাকলে আমাকে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে চার্জ করতে হতো। এখন আমার ঘরে বিদ্যুৎ আছে।
আরস সিকদারপাড়ার ৬৪ বছর বয়সী বজল করিমের বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে এক মাস হলো।
তিনি বলেন, আমি এখন আমার বাড়িতে একটি রাইস কুকার ব্যবহার করতে পারি। আমিও একটা ফ্রিজ কিনলাম। আমি এতে মাছ রাখতে পারি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা জানান, গত এপ্রিলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার পর এলাকার মানুষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রতিও মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।
কুতুবদিয়া উপজেলা সদরের বড়ঘোপ বাজারের ব্যবসায়ী করিম উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার কুতুবদিয়াবাসীর স্বপ্ন পূরণ করেছে।
তিনি বলেন, কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ আসবে তা কখনো ভাবিনি। আমরা ১২ এপ্রিল রাত থেকে বিদ্যুৎ পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের জীবন দ্রুতই বদলে গেছে।
এদিকে কুতুবদিয়া উপজেলার লেমশিখালী গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল আলমের বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। এছাড়া বাড়ির লোকজন রঙিন টেলিভিশনে খবর দেখছেন।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের অভাবে শিশুরা বেশিক্ষণ অন্ধকারে ঘরে বসে লেখাপড়া করতে পারত না। এখন তারা কম্পিউটারও ব্যবহার করতে পারে।
জেলে জালাল আহমদ জানান, এতে অন্তত ৩৪ হাজার জেলে উপকৃত হবে। তিনিসহ কয়েকজন মাছ সংরক্ষণে হিমাগার নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কুতুবদিয়ার প্রবীণরা জানান, কোভিড-১৯ মহামারির সময় সারাদেশের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারলেও কুতুবদিয়ার শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল।
দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, দ্বীপের ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালে রাতে কয়েক ঘণ্টা জেনারেটর দিয়ে চিকিৎসা সেবা চালানো হয়। যদি জেনারেটর শৃঙ্খলার বাইরে ছিল, মোমবাতির আলোতে বিভিন্ন চিকিৎসা করা হয়েছিল। এখন সে অবস্থা নেই।
দ্বীপের বাসিন্দারা আরও জানান, বিদ্যুৎ পাওয়ায় তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
আরও পড়ুন: মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ডিসেম্বরে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী: কর্মকর্তারা