গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকাকালে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্নের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনকে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
বুধবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও অ্যাডভোকেট একরামুল হক টুটুল।
দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান।
আরও পড়ুন: স্ত্রীর মামলায় সেই বিচারকের হাইকোর্টে জামিন
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
মঙ্গলবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পশ্চিম ভিরুলিয়া সরকার বাড়ীর ওসমান গনি সরকারের ছেলে মো. আব্দুর রহিম সরকার হাইকোর্টে এ রিট করেন।
রিটে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত দ্রুত শেষ করতে আবেদন জানানো হয়।
এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে ‘গ্রাফ্ট ইজ হিজ মিডল নেইম’ শীর্ষক শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদন যুক্ত করা হয় রিট আবেদনটিতে।
রিটে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র থাকাকালীন আসা দুর্নীতির অভিযোগ দুদক আইনে বেধে দেয়া সময়ে অনুসন্ধান শুরু বা শেষ করতে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না এবং অবিলম্বে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন এবং আইন অনুসারে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে।
পাশাপাশি তদন্ত রিপোর্ট হাইকোর্টে দাখিলের নির্দেশনাও চাওয়া হয়।
রিটে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, স্থানীয় সরকার সচিব, অতিরিক্ত সচিব মোস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী, বিএফআইউ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র এবং জাহাঙ্গীর আলমকে বিবাদী করা হয়েছে।
ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহাঙ্গীর আলম ও তার অনুসারীরা দুর্নীতিতে কিছুই ছাড়েননি। এমনকি জাতীয় শোক দিবসে দুঃস্থদের খাওয়ানোর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থও তারা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (জিসিসি) প্রতিটি ক্ষেত্র ছুঁয়েছে তাদের দুর্নীতির হাত।
অনুদান বিতরণ, বালু ভরাট, সড়ক প্রশস্তকরণ-এমনকি নালা-নর্দমা পরিষ্কার থেকে বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের জন্য দেয়া খাবারের মতো ছোট আকারের কর্মকাণ্ডে ও ভাগ বসিয়েছেন জিসিসির বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও তার অনুসারীরা।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থও এর বাইরে ছিল না।
আরও পড়ুন: আদর্শ প্রকাশনীর বইমেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত
জিসিসির অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অজস্র অভিযোগের এমন বিশদ বিবরণ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গঠিত একটি তদন্ত কমিটির তৈরি এ প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীরের বিভিন্ন দুর্নীতি-অপকর্মের তথ্যসহ বিভিন্ন পর্যবেক্ষণও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গাজীপুর সিটি করপোরেশন গত তিন অর্থবছরে (২০১৮-২০১৯, ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১) আটটি এলাকায় বর্জ্য অপসারণে ব্যয় করেছে ১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
অথচ সেসব এলাকার কোনো আবর্জনা পরিষ্কার না করেই এর বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
জিসিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বর্ণনা করা হয়েছে যে কীভাবে জাহাঙ্গীরের তত্ত্বাবধানে সব আইন উপেক্ষা করে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন দল তাকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেয়।
এরপর তার দুর্নীতি ও অপকর্মের বিষয়গুলো আবারও সামনে আসে।
২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হলে জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ভিডিওতে তাকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করতে এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
দল থেকে বহিষ্কারের সাত দিন পর ২৫ নভেম্বর তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সে সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ভূমি দখল, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারি অর্থের অপব্যবহারের অভিযোগকে জাহাঙ্গীরের স্থগিতাদেশের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে।
পরে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে দলের পক্ষ থেকে সাধারণ ক্ষমার পর জাহাঙ্গীরের অনুসারীরা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছেন।
দলের ভেতরকার সূত্রগুলো বলছে, তারা এখন জাহাঙ্গীরের মেয়র পদ পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
তবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ওপরেই নির্ভর করছে এ সিদ্ধান্ত।
গত সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রী বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা তা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেব।
তদন্ত কমিটির সদস্য মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, এখনও মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়নি। আমরা গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে বিভিন্ন কাগজপত্র জমা দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। এখন আমরা সেই নথিগুলো বিশ্লেষণ করছি। আমরা শিগগিরই প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ করব।
আরও পড়ুন: ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতি কালো দাগ সৃষ্টি করেছে: হাইকোর্ট
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে বলে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।