ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে পারফরম্যান্স বোনাসের (উৎসাহ ভাতা) দেয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে, কোনও বিধি প্রণয়ন ছাড়াই খেয়াল-খুশিমতো পানির দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) করা রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি করে বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যেতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায় ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সামসুন নাহার লাইজু।
পরে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, ঢাকা ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এ সুস্পষ্টভাবে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পানির মূল্য বৃদ্ধির কথা বলা থাকলেও কোনো বিধি প্রণয়ন ছাড়াই খেয়াল খুশিমত পানির মূল্য বৃদ্ধি এবং অবৈধভাবে ওয়ায়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস দেয়াকে চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করে ক্যাব। উভয় পক্ষে দীর্ঘদিন শুনানি হওয়ার পর যেকোনও সময় রায় দেয়ার কথা ছিল। আজ উচ্চ আদালত বিধি বহির্ভূতভাবে পানির মূল্য নির্ধারণ ও পারফরম্যান্স বোনাস দেয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন।
তিনি আরও জানান, যেহেতু অন্যায় কাজগুলো আগেই সমাপ্ত হয়েছে তাই সেসব বাতিল না করে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে বিধি ছাড়া যেন পানির মূল্য নির্ধারণ করা না হয় এবং পারফরম্যান্স বোনাস দেয়া না হয় সে মর্মে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। মহামান্য আদালতের কাছে বিধি প্রণয়ন না হওয়ায় পর্যন্ত জুডিশিয়াল গাইডলাইন করে দেয়ার যে আবেদন ছিল তা আপাতত মঞ্জুর করা থেকে বিরত থেকেছেন এবং প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন যে সরকার অনতিবিলম্বে বিধি প্রণয়ন করে বিদ্যমান অসুবিধা দূর করবে।
বিধি প্রণয়ন না করে পানির মূল্য নির্ধারণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন যুক্ত করে গত বছরের ৩১ জুলাই ক্যাবের পক্ষে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ওই রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ১৬ আগস্ট ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘পারফরম্যান্স বোনাস’ হিসেবে প্রণোদনা দেয়ার ওপর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কোনো বিধি প্রণয়ন না করে পানির মূল্য নির্ধারণ করা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: ওয়াসার এমডি বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান অগ্রগতি জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকা ওয়াসা বোর্ড, ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
হাইকোর্টের এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করা হলে তাতে সাড়া দেননি আদালত। পরে গত বছরের ১১ অক্টোবর আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত এ বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখে মূল মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।
সে অনুযায়ী গত ১৬ নভেম্বর ওয়াসার পক্ষে ব্যারিস্টার এ এম মাসুম একটি এফিডেভিট দাখিল করেন।
তাতে বলা হয় ২০১১-২০১২ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত ৮টি অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস দেয়া হয়। এর মধ্যে ২০১১-২০১২ অর্থবছরে পারফরম্যান্স বোনাস বাবদ দেয়া হয় ২ কোটি ৯৯ লাখ ৭০ হাজার ৫৫০ টাকা। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে দেয়া হয় ৩ কোটি ১লাখ ৩৮ হাজার ২১৯, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে দেয়া হয় ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৯২ হাজার ৮১টাকা, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে দেয়া হয় ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩১০ টাকা, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দেয়া হয় ৯ কোটি ৬০ লাখ ৮৮ হাজার ৭১৭ টাকা, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেয়া হয় ২৩ কোটি ২৩ লাখ ৭৯হাজার ২৫৩টাকা, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেয়া হয়েছে ২৩ কোটি ৬২ লাখ, ৪০ হাজার ৫১৫টাকা, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেয়া হয়েছে ১৭ কোটি ৭৮লাখ ৫১ হাজার ৫১৭টাকা।
আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওয়াসা প্রথম ৫টি অর্থবছরে ১টি করে উৎসাহ বোনাস দিলেও; ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৪টি, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৪টি এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩টি উৎসাহ বোনাস দিয়েছে। তবে ২০১৩-২০১৪ এবং ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে কোনও উৎসাহ বোনাস দেয়া হয়নি।
ওয়াসার এফিডেভিটে আরও বলা হয়, ওয়াসা আইনের ধারা ২২ অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির কারণে কোনও রকমের বিধি প্রণয়ন করা ছাড়াই বোর্ডের অনুমতি নিয়ে প্রতি বছর ৫শতাংশ হারে দাম বৃদ্ধি করতে পারে। ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকরি প্রবিধানমালা-২০১০ এর ৩৪(৩) বিধি অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস দিতে পারে।
এদিকে সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৫ বার ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছে। এ অবস্থায় বিধি তৈরি না করেই পানির দাম বাড়ানো এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে পারফরম্যান্স বোনাসের নামে টাকা বিতরণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করে ক্যাব।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘বিধি প্রণয়ন ছাড়া পানির মূল্য নির্ধারণ ১৯৯৬ সালের ওয়াসা আইনের ২১ ও ২২ ধারার পরিপন্থী।’ আদালত উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে বৃহস্পতিবার পারফরম্যান্স বোনাস ঘোষণা ও বিধি ছাড়া পানির মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ঢাকা ওয়াসার কর্মীদের উৎসাহ বোনাসে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা