অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন,আমাদের আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে যে, কীভাবে লাখ লাখ তরুণকে এমন একটি কর্মক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলা যায়- যেখানে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, নৈতিকতাও কঠিন দক্ষতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
১১তম ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা তারপরও ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রবাবে লাখ লাখ লোককে পুনরায় দক্ষ করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হয়েছি।’
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং ডি-৮ সেক্রেটারি জেনারেল অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
এখন মৌলিক এআই-ভিত্তিক সরঞ্জাম এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলোর সুবিধা আছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আসুন আমরা একটি সহযোগিতামূলক শিক্ষা কর্মসূচি সম্পর্কে চিন্তা করি, যা আমাদের জাতীয় উদ্যোগের পরিপূরক হতে পারে।’
অধ্যাপক ইউনূস কায়রো ঘোষণা এবং সম্মেলনের ফলাফল গ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সমাধানে তাদের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা ও অভিন্ন অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটান। সকলকে তাদের সম্মিলিত কর্মসূচিগুলোকে নতুন করে দেখার আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপায় হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা দুটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের প্রস্তাব করেন।
ফলিত বিজ্ঞান বিষয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'প্রথমত, আসুন আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকরী, প্রভাবিত সংযোগ তৈরি ও গভীর করি, বিশেষত ছেলে এবং মেয়েদের স্বার্থে তাদের উদ্যোক্তা হিসাবে প্রস্তুত করার দিকে মনোনিবেশ করি।’
ড. ইউনূস বলেন, উদ্যোক্তা ও উচ্চতর জ্ঞানকে বর্তমানের চেয়ে অনেক কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ফলাফল ভিত্তিক জ্ঞানার্জন। যা ডি৮ দেশগুলোর তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক বাজারের নেতাদের কাছ থেকে বিশ্বব্যাপী সুরক্ষিত ব্যবসা এবং শিল্প তৈরি করতে পারে। যদি ডি-৮ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কাঠামোর দিকে নতুন করে নজর দিতে বলা হয়, তাহলে আমাদের তা করা উচিত।’
ড. ইউনূস বলেন, মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যবসার পরিবর্তন কেবল মাত্র তাদের পেশা হবে না, বরং তারা নতুন সভ্যতা গড়তে সামাজিক ব্যবসায় জড়িত হবে।
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত, বহু বছর ধরে আমরা প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে আমাদের দেশগুলোতে লাখ লাখ লোককে মৌলিক শিক্ষা এবং দক্ষতা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘১২০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায়শই এটি একটি ক্রমবর্ধমান কঠিন কাজ। একটি পর্যায়ে পৌঁছাতে আমরা দূরশিক্ষণের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি।’
তিনি বলেন, তারা এমন এক সময়ে মিলিত হচ্ছেন যখন বিশ্ব নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ‘তারপরও অনেক সুযোগ আমাদেরও তাক লাগিয়ে দিচ্ছে।’
ড. ইউনূস বলেন, 'তরুণ ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ওপর আলোকপাত করা এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য আমাদের অভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যথাযথভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।’
ডি-৮ দেশগুলোতে বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গড় মধ্যবয়সী (২৭ বছর) বেশি।
তিনি বলেন, প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। একটি বেসরকারি খাত চালিত অর্থনীতিতে, আমরা যখন তাদের বাজারের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করি বা চটপটে উদ্যোক্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশে উৎসাহিত করি, তখন আমরা দেখতে পাই যে প্রযুক্তির উত্থান কীভাবে চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলো তৈরি করছে যা আগে কখনও হয়নি।
আমাদের দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং ল্যান্ডস্কেপে লাখ লাখ শ্রমিক রয়েছে যাদের সাধারণত কম দক্ষ।
আরও পড়ুন: সম্পর্কোন্নয়নে একাত্তরের সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানের প্রতি ড. ইউনূসের আহ্বান
ড. ইউনূস বলেন, 'কিন্তু আগামীর উৎপাদন ও সেবা অর্থনীতি দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে, যা মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ডেটা-চালিত সরঞ্জাম এবং অ্যাপ্লিকেশনের উপর নির্ভর করে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কৃষি এখনও সমাজ ও অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। তারা দেখতে পায় যে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র কৃষকের সন্তানরা তাদের পিতামাতারা ঐতিহ্যের বিষয় হিসাবে যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন সেভাবে তাদের জন্য কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রায়শই অনিশ্চিত কৃষিকাজ করতে খুব কমই আগ্রহী।
ড. ইউনূস বলেন, 'বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চল এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও আরব বিশ্ব জুড়ে ভ্রমণ করে আমি দেখেছি আজকের লাখ লাখ তরুণ চারপাশের সবকিছুতে দ্রুত প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনকে গ্রহণ করছে। এটি হচ্ছে- হয় দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ ঘুরিয়ে দিতে অথবা নতুন নতুন সুযোগের সন্ধান করতে। এসব কয়েক বছর আগেও অনেকে অসম্ভব বলে মনে করত।
প্রায়শই, তরুণরা মাঠে অসহনীয় জলবায়ু চাপ মোকাবিলায় অদ্ভুত কল্পনা করছে।
ড. ইউনূস বলেন, 'আমি বিশেষ করে এটি গুরুত্ব দিচ্ছি যে, আমাদের কৃষি ও খাদ্য আমাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করতে এবং আমাদের নিজস্ব সমাজে সম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হচ্ছে।’
এর ফলে লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) তাদের বিবেচনায় আসে।
বেশিরভাগ এসএমই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির মধ্যে সাফল্য লাভ করে। তারা বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে বৃদ্ধি এবং সংযুক্ত হতে চায়।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘প্রায়শই, তাদের আনুষ্ঠানিক কাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন বা সমর্থন আর্কিটেকচারের সুবিধার অভাব রয়েছে এবং তারা বাজারের নিয়ম-অনুশীলন-মানগুলোর সঙ্গে অপরিচিত। তবুও, আমি দেখতে পাচ্ছি যে এসএমইগুলো কতটা আশ্চর্যজনকভাবে সক্ষম এবং প্রতিযোগিতামূলক।’
তিনি বলেন, ডি-৮ দেশগুলোতে সম্মিলিতভাবে তাদের যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে। এমনকি ব্যক্তিগত জনকল্যাণমূলক অবস্থায়ও এই অসংখ্য এসএমইর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের সামান্য সমর্থন দিয়ে আমরা তাদের জন্য এবং আমাদের জনগণের জন্য একটি পুণ্যময় 'শুভ চক্র' গঠন করতে পারি। আমাদের উচিত ঝুঁকিমুক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে তাদের কাছে অর্থ প্রবাহের সুযোগ করে দেওয়া।”
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা যা আলোচনা করি তার বাইরে আমরা ডি-৮ সরকারগুলো, যুব সম্প্রদায় - স্টার্টআপ - ব্যবসা - অর্থের সঙ্গে জড়িত অকপট, ফলাফল-ভিত্তিক কথোপকথনের আয়োজন করি। দেখুন আমরা তাদের মধ্যে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারি কিনা। বাংলাদেশ এ ধরনের উদ্যোগ এগিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকবে এবং ২০২৫ সালে প্রথম মাল্টি-স্টেকহোল্ডারদের বৈঠক আহ্বান করুন।’
তিনি বলেন, যুব উদ্যোক্তাদের বিশ্ব হিসাবে 'কাজের ক্ষেত্র' যেভাবে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, ডি-৮ দেশগুলোকে তাদের ছেলে এবং মেয়েদের অর্থনীতির নেতা হওয়ার জন্য জায়গা তৈরি করতে 'শিক্ষা' পুনরায় উদ্ভাবন করতে হবে।
ইউনূস বলেন, 'আমাদের দেশে রয়েছে সুমহান ঐতিহ্য, প্রজ্ঞা ও অর্জন। আমাদের দেখতে হবে কীভাবে আমরা সেগুলো সন্নিবেশিত করতে পারি এবং তৈরি করতে পারি।বহু বছর ধরে আমাদের সঙ্গে থাকা ডিজিটাল বিপ্লবের পূর্ণ সুবিধা আমরা এখনও গ্রহণ করতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, 'এখন যেহেতু এআই এসেছে, আসুন আমরা চিন্তা করি, আমাদের উদ্যোক্তা ছেলে-মেয়েদের সুবিধার্থে লাফিয়ে বাধাগুলো দূর করতে পারি।’
আরও পড়ুন: সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে চলতি মাসেই ঘোষণার ইঙ্গিত ড. ইউনূসের