আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রচারে পোস্টার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির এই সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। পরিবেশ দূষণ রোধে এই সিদ্ধান্ত সহায়ক হবে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাগজ বা পোস্টার ব্যবহারে বন উজাড় হয়, তাছাড়া বর্ষার মৌসুমে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ওই প্লাস্টিকের প্রলেপ দেওয়া পোস্টারগুলো পয়ঃনিষ্কাশন ও জলপথ বন্ধ করে দিয়ে পরিবেশ দূষণের কারণ হয়।
এর আগে, গত ১৯ জুন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য প্রণীত ২০২৫ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধির খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয় ইসি। এতে নির্বাচনী প্রচারে পোস্টার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই সুপারিশ করা হয়।
তবে প্রথমবারের মতো এই আচরণবিধিতে বিলবোর্ড ব্যবহারের অনুমতি রাখা হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবদুল আলিম জানান, পোস্টার নিষিদ্ধ করার পেছনে চারটি প্রধান কারণ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে— পরিবেশগত ক্ষতি, অশোভন প্রচারপদ্ধতি, অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় ও পোস্টার ঘিরে সংঘর্ষজনিত সহিংসতা।
আরও পড়ুন: নতুন ভোটারদের নিবন্ধনের সময়সীমা নির্ধারণের ক্ষমতা চায় ইসি
তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘পোস্টার ব্যবহার একটি অশোভন পদ্ধতি, যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দেখা যায় না— এমনকি ভুটান নামক ছোট দেশেও না। এখন আমাদের কাছে বিকল্প রয়েছে, যেমন: সোশ্যাল মিডিয়া ও বিলবোর্ড।’
ড. আলিম বলেন, প্রচলিত পোস্টার বন উজাড়ে ভূমিকা রাখে এবং লেমিনেটেড ও পলিথিনের প্রলেপ দেওয়া পোস্টার পরিবেশ দূষণ ঘটায়।
তিনি আরও বলেন, ‘পোস্টারের সংখ্যা নির্বাচন কমিশনের নজরদারির আওতায় আনা যায় না। আর নির্বাচনকালে পোস্টার নিয়ে বিরোধ থেকেই অনেক সহিংস ঘটনার সূত্রপাত হয়।’
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা (ইএসডিও) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে আনুমানিক ২৭ হাজার টন প্লাস্টিকের আবরণ দেওয়া পোস্টার ও কার্ড ব্যবহার করা হয়েছিল।
ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী শহরের ছাপাখানাগুলো নিয়ে পরিচালিত এক জরিপের ভিত্তিতে এ হিসাব করা হয়।
ইএসডিওর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন ইউএনবিকে বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারে পোস্টার ব্যবহারের প্রবণতা কোনো সভ্য দেশে দেখা যায় না। এত বিপুলসংখ্যক পোস্টার ব্যবহার শুধু বিশৃঙ্খলাই সৃষ্টি করে না, এটি একদিকে অর্থের অপচয়, অন্যদিকে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি।’
পরিবেশবিদ অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, অতীতে লেমিনেটেড পোস্টার নিষিদ্ধ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের পোস্টার নিষিদ্ধের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটি পোস্টার ঘিরে যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, তা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’
আরও পড়ুন: নিবন্ধনের শেষ দিনে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিড়
তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিকের প্রলেপ দেওয়া পোস্টারগুলো নগর এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে জলাবদ্ধতা বাড়ায়। আর সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হলে বায়ু দূষণ বাড়ে।’
নির্বাচনী প্রচারে পোস্টার ব্যবহারে বিপুল পরিমাণ কাগজের প্রয়োজন হয়, যা সরাসরি বন উজাড়ে সহায়তা করে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘যদি এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে একটি পরিচ্ছন্ন প্রচার সংস্কৃতির সূচনা হতে পারে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবিরও নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত গাছ বাঁচাবে এবং কাগজ তৈরির সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক দূষণ কমাবে, ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস পাবে।