মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এএ) ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য একটি স্পষ্ট জাতীয় কৌশল প্রণয়নের ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা সতর্ক করেছেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে সময়মতো যোগাযোগ স্থাপন না করলে ‘সুযোগ হারানোর’ আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষত যখন বহির্বিশ্ব নৌপথের মাধ্যমে রাখাইনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস) আয়োজিত ‘মংডুর পতনের পর রাখাইন: বাংলাদেশের ও অঞ্চলের জন্য প্রভাব’ শীর্ষক এক নীতিনির্ধারণী আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে।
এতে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সাবেক কূটনীতিক এবং শিক্ষাবিদরা রাখাইন রাজ্যের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনাটি পরিচালনা করেন বিআইপিএসএস-এর প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামান।
আলোচকদের মধ্যে ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) শাহিদুল হক, মিয়ানমারে বাংলাদেশের প্রাক্তন ডিফেন্স অ্যাটাশে এবং লিবিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসি।
রাখাইনে আরাকান আর্মির আধিপত্য
আলোচনায় জানানো হয়, রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, যার মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তও অন্তর্ভুক্ত।
উদ্বোধনী বক্তব্যে বিআইপিএসএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনির বলেন, পরিস্থিতি থেকে সুবিধা আদায়ের উপায় খুঁজে বের করার কৌশল নিতে হবে। আলোচকরা আরাকান আর্মির সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
মুনিরুজ্জামান ভারত কীভাবে তার মিয়ানমার কৌশল পুনর্বিন্যাস করেছে তা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশেরও স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি রাখাইনের কৌশলগত গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এটি বঙ্গোপসাগরের নৌপথে প্রবেশাধিকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং অঞ্চলটি সম্পদসমৃদ্ধ ও বহু-জাতিগোষ্ঠী সমন্বিত।
চীনা এবং ভারতীয় স্বার্থ
তিনি আরও বলেন, রাখাইন রাজ্যের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়ছে, বিশেষ করে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের পরিপ্রেক্ষিতে। এছাড়া চীন-মিয়ানমার তেল ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প রাখাইনের সংযোগকেন্দ্র হিসাবে ভূমিকা তুলে ধরে।
সহকারী অধ্যাপক আব্বাসি বলেন, জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন একটি বাস্তবধর্মী কৌশল। সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব না হলে অনানুষ্ঠানিক উপায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিনি সতর্ক করেন, আরাকান আর্মির আধিপত্য বাড়লে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
আব্বাসি বলেন, রাখাইনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের অংশগ্রহণহীনতা উল্লেখযোগ্য। তিনি মিয়ানমারকে একটি ‘ছায়াযুদ্ধের ক্ষেত্র’ হিসেবে অভিহিত করেন। এছাড়া রাখাইনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কূটনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তনকে তিনি ভূরাজনৈতিক অগ্রসরতার প্রতিফলন বলে উল্লেখ করেন।
রোহিঙ্গা সংকট এবং আরাকান আর্মি
আব্বাসি আরও বলেন, আরাকান আর্মির ‘আরাকান স্বপ্ন’ রোহিঙ্গাদের কোনো স্থান দেয় না। তিনি সতর্ক করেন যে, আরাকান আর্মি পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে কনফেডারেশন পদ্ধতির পক্ষে থাকলেও তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
শাহিদুল হকের দৃষ্টিভঙ্গি
মেজর জেনারেল (অব.) শাহিদুল হক আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকে ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এটি একদিকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবে। তবে তিনি সতর্ক করেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
নীতি নির্ধারণী আলোচনার সমাপ্তি
আলোচনা শেষে অংশগ্রহণকারীরা নিরাপত্তা ঝুঁকি, অর্থনৈতিক সুযোগ এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে মতবিনিময় করেন। তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুনর্বাসন প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন। পাশাপাশি আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।