বহুল আলোচিত এ আইন ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। এর আগে ২২ অক্টোবর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
খুলনা: সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা। ধর্মঘটে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। ভোরে কয়েকটি পরিবহনের বাস মহানগরীর রয়্যাল কাউন্টার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেলেও সকাল ৯টার পর থেকে সব বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দুর্ভোগে পড়া যাত্রী ফরিদপুরের রাজিয়া আক্তার বলেন, ‘গ্রামে যাওয়ার জন্য সকালে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি গাড়ি চলছে না। জরুরিভাবে গ্রামে যাওয়া দরকার ছিল। এখন সমস্যায় পড়তে হলো।’
ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মামুন শেখ জানান, ছুটি শেষ হওয়ায় ঢাকা যাওয়ার জন্য তিনি রবিবার রাতে ফাল্গুনী পরিবহনের টিকিট কাটেন। কিন্তু সোমবার সকালে পরিবার নিয়ে ঢাকায় যেতে ওই পরিবহনের কাউন্টারে গেলে তারা টিকিট নিয়ে টাকা ফেরত দিয়ে দেয়।
বাগেরহাটের নাসিমা বেগম জানান, কুষ্টিয়া যাওয়ার জন্য সকালে বাগেরহাট থেকে ভেঙে ভেঙে খুলনায় আসেন তিনি। কিন্তু এখানে এসে জানতে পারেন বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।
পরিবহন শ্রমিক নেতারা বলছেন, দুর্ঘটনার মামলা জামিনযোগ্য করাসহ সড়ক পরিবহন আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন চান চালকরা। সংশোধনের পরই এটি কার্যকর করা হোক। তা না করা পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।
তারা বলেন, বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও আইনটি সংশোধন ছাড়াই বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। এতে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ২১ ও ২২ নভেম্বর শ্রমিক ফেডারেশন বর্ধিত সভা ডেকেছে।
খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম বেবী বলেন, ‘নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের প্রতিবাদে শ্রমিকরা বাস চালাচ্ছেন না। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি শুরু করেছেন।’
জেলা বাস মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, ‘শ্রমিকরা ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দণ্ডের ভয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিচ্ছেন। আমাদের সাথে আলোচনা না করেই তারা এসব করছেন।’
সাতক্ষীরা: হঠাৎ করেই সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার যাত্রী দুর্ভোগে পড়েছেন। তারা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে নছিমন, করিমন ও ইজিবাইক যোগে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।
জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা চান, আগে আইনটি সংশোধন এবং পরে বাস্তবায়ন করা হোক।
শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দিলে মালিক পক্ষের কিছু করার থাকে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ঝিনাইদহ: ঝিনাইদহ থেকে যশোর, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও চুয়াডাঙ্গা রুটসহ অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন চালকরা। বাস না পেয়ে যাত্রীরা ইজিবাইক ও মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ বিভিন্ন তিন চাকার যানবাহনে যাতায়াত করছেন। তবে স্থানীয় সব রুট বন্ধ থাকলেও ঢাকাসহ দূরপাল্লার পথে বাস ও ট্রাকসহ অন্যান্য পরিবহন চলাচল করতে দেখা গেছে।
রাজশাহী: জেলা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। দু-একটি বাস ছাড়ার চেষ্টা করলেও শ্রমিকরা যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। তবে ঢাকাগামী বাস রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে, নগরীর শিরোইল ও নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল এবং ভদ্রা মোড়ে অবস্থান নিয়ে মোটর শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় তারা নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রত্যাহারের দাবি জানান।
জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এটি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ডাকা কোনো ধর্মঘট নয়। সকাল থেকে শ্রমিকরা নিজেরাই বাস বন্ধ রেখেছেন।’
সকালে রাজশাহীর মালিকদের বাস দু-একটি করে নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে ছেড়ে যায়। তবে বাইরের জেলার মালিকদের বাসগুলো রাজশাহী আসার পর পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বাস চলছে না রাজশাহী-নওগাঁ রুটে। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ের রুটেও শহর থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি।
নড়াইল: যশোর ও লোহাগড়াসহ অভ্যন্তরীণ পাঁচ রুটে কোনো ঘোষণা ছাড়া বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা। রবিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া এ কর্মসূচির ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা।
জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান সোমবার সকালে বলেন, ‘বাস বন্ধ রাখার ব্যাপারে সংগঠন থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। কিন্তু আমাদের সাথে আলাপ না করেই বাস চালক ও শ্রমিকরা নতুন পরিবহন আইনের ভয়ে স্বেচ্ছায় অভ্যন্তরীণ পাঁচ রুটে বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে বিক্ষিপ্তভাবে কোনো কোনো রুটে দু-একটি বাস চলছে।’
চুয়াডাঙ্গা: পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করছেন বাস শ্রমিকরা। চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ ও দূরপাল্লার যাত্রীরা। অনেকে টার্মিনাল, বাসস্ট্যান্ড ও কাউন্টারগুলোতে এসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ফিরে যাচ্ছেন।
জেলা বাস-ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এম. জেনারেল ইসলাম বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে শ্রমিকদের আপত্তির বিষয়টি সমাধানে সরকার কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় তারা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন। ধর্মঘট চলতে পারে অনির্দিষ্টকালের জন্য।
তবে জেলায় প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক ও নসিমন-করিমনসহ ছোট যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
বেনাপোল: বাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকায় বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে কোনো পণ্য খালাস হয়নি। শত শত খালি ট্রাক পণ্য বোঝাইয়ের জন্য বন্দরের সামনে অবস্থান করছে।
নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের প্রতিবাদে যশোর থেকে এ ধর্মঘট শুরু হয় রবিবার। সোমবার তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়।
বাংলাদেশ পরিবহন সংস্থা শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা হোসেন জানান, পরিবহন শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় বাস চালাচ্ছেন না।
বেনাপোল-যশোর ও যশোর-সাতক্ষীরার অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল না করলেও কার, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, মাহেন্দ্র, নসিমন-করিমন জাতীয় ছোট যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
ঈগল পরিবহনের বেনাপোল অফিসের ব্যবস্থাপক এমআর রহমান বলেন, ‘ঢাকা-কলকাতা ও বেনাপোল থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য স্থানে দূরপাল্লার সব বাস চলাচল করছে। তবে অভ্যন্তরীণ রুটে কোনো বাস চলাচল করছে না।’
গত বছর রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে আগের আইন কঠোর করে ‘সড়ক পরিবহন বিল-২০১৮’ জাতীয় সংসদে ১৯ সেপ্টেম্বর পাস করা হয়। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় দায়ীদের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এ আইন চলতি বছরের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হলেও এটি সম্পর্কে সবার স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণ দেখিয়ে আরও দুই সপ্তাহ পর রবিবার থেকে পুরোপুরি কার্যকর করে সরকার। এরপর থেকেই বিভিন্ন জেলায় শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি শুরু করেন।