তিন বছর আগে সাভারের একটি মাদ্রাসার কবরস্থানে ‘মাহমুদুর রহমান’ নামে এক ব্যক্তিকে দাফন করা হয় যার জীবন ও পরিচয় ছিল রহস্যে ঘেরা। তবে আদালতের নির্দেশে সেই ব্যক্তির লাশ তুলে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে আজ সেই রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।
মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করা হলেও তিনিই যে বহু বছরের রহস্যে ঘেরা বিএনপি নেতা আবুল হারিছ চৌধুরী, তা এখন নিশ্চিত।
কবর থেকে তুলে এনে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু একজন মানুষের পরিচয়ই শনাক্ত করা হয়নি, বরং বছরের পর বছর ধরে চলা জল্পনার অবসান ঘটিয়ে এমন একটি গল্প বের করে আনা হয়েছে, দীর্ঘদিন যা মাটির নিচে সমাহিত ছিল।
লাশ উত্তোলন ও ডিএনএ পরীক্ষা
হাইকোর্টের নির্দেশে গত ১৬ অক্টোবর কবর থেকে ‘মাহমুদুর রহমান’ নামের ওই ব্যক্তির লাশ উত্তোলন করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর লাশের ডিএনএ নমুনা হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরীর ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। পরীক্ষায় দুজনের ডিএনএ মিলে গেলে নিশ্চিত হয়ে যায়, মাহমুদুর রহমান নয়, লাশটি হারিছ চৌধুরীরই ছিল।
এরপর বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের হাইকোর্ট বেঞ্চ হারিছ চৌধুরীকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথাযথ সম্মান দিয়ে তাকে তার পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী দাফন করার অনুমতি দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ডিএনএ মিলেছে, হারিছ চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের নির্দেশ
সামিরা তানজিন চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহদীন চৌধুরী বলেন, আদালতের এই রায় তার পরিবারের জন্য বহুল প্রতীক্ষিত ন্যায়বিচার দিয়েছে।
স্বস্তি প্রকাশ করে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন বলেন, সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ একটি নাটক রচনা করে বাবার মৃত্যুকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মিডিয়া একটির পর একটি রিপোর্ট করলেও হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। এটি নিয়ে যেন কখনও প্রশ্ন না ওঠে, সেটি নিশ্চিত করার জন্যই এ রিট করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ থাকবে- সন্তান হিসেবে এটি খুব মর্মান্তিক, কষ্টদায়ক।’ এখনও মানুষ জিজ্ঞেস করে- সত্যিই কি তিনি মারা গেছেন? এ নিয়ে আমাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই বিষয়টি বন্ধের জন্য আমরা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি এবং আজ ন্যায়বিচার হয়েছে।’
রহস্যে ঘেরা এক জীবন
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন হারিছ চৌধুরী। তবে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। আর তখন থেকেই নিখোঁজ হন এই রাজনীতিক।
সে বছর দেশে জরুরি অবস্থা জারির সপ্তাহখানেক পর স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগরে বেড়াতে যান হারিছ চৌধুরী। ওই রাতেই যৌথবাহিনী তার বাড়িতে অভিযান চালায়, তবে তাকে পায়নি।
এরপর কয়েক দিন সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থেকে ২০০৭ সালের ২৯ জানুয়ারি জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান বিএনপি সরকারের দাপুটে এই নীতিনির্ধারক।
ভারতে গিয়ে তিনি ওঠেন নানার বাড়ি ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুরে। এরপর পাকিস্তান হয়ে ইরানে তার ভাই আবদুল মুকিত চৌধুরীর কাছে পৌঁছান- এমন খবরও চাউর হয়। ইরান থেকে তিনি যুক্তরাজ্যে পরিবারের কাছে যান। সেখান থেকে এই বিএনপি নেতা নিয়মিত ভারতে যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্য দেখভাল করতেন বলে বিভিন্ন সময় নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র।
স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে হারিছ চৌধুরী যুক্তরাজ্যে থাকতেন। তার ছেলে জনি চৌধুরী পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার, আর মেয়ে ব্যারিস্টার।
আগে থেকেই হারিছ চৌধুরী ব্ল্যাড ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে একবার রক্ত পরিবর্তন করে আসেন। দেশ ছাড়ার পর তিনি যুক্তরাজ্যে আরেকবার রক্ত পরিবর্তন করেন বলে জানা যায়।
২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন বলে গুজব ছড়ালেও সে সময় এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীরাও তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।
এরপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজা হয় হারিছ চৌধুরীর। একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার সাত বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা হয়। এছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় হারিছ চৌধুরী ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
‘মাহমুদুর রহমান’ ছদ্মনামে দেশে বসবাস করার একপর্যায়ে ২০২১ সালে তিনি করোনায় আক্রন্ত হন।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, আক্রান্ত হওয়ার আগে হারিছ চৌধুরী করোনার দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন, এরপরও তিনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর তার শরীরের রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং পুরো ফুসফুস সংক্রমিত হয়ে পড়ে। ফলে করোনা থেকে সেরে ওঠার পরও তিনি ফুসফুস জটিলতায় ভূগছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আরও পড়ুন: ডিএনএ পরীক্ষার জন্য বিএনপি নেতা হারিছের লাশ তোলা হয়েছে
মৃত্যুর পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপে তার পরিচয় গোপন রেখেই সাভারের জালালাবাদ এলাকার একটি মাদ্রাসার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। সে সময় তার প্রকৃত পরিচয় অনুযায়ী মৃত্যুসনদও দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে আইনজীবী মাহদীন চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি (হারিছ চৌধুরী) ধানমণ্ডির পান্থপথের একটি বাড়িতে বসবাস করেন। প্রশাসনের নাকের ডগার ওপর দিনের পর দিন থেকে গেলেও সরকার যে তাকে শনাক্ত করতে পারেনি, এটি ফ্যাসিস্ট সরকারের ব্যর্থতা ছিল। সে কারণেই তার মৃত্যুর পর তারা চায়নি যে হারিছ চৌধুরীর পরিচয় প্রকাশ তাদের ব্যর্থতা সবার সামনে ফুটে উঠুক। সে কারণেই তার পরিচয় গোপন রেখে দাফন করতে বাধ্য করা হয়।
তবে দীর্ঘকাল পর আদালতের নির্দেশে আর প্রযুক্তির সহায়তায় উন্মোচিত হয়েছে হারিছ রহস্য। সেইসঙ্গে তিনি পেয়েছেন পরিচয়, স্বীকৃতি। আর দীর্ঘদিনের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছে তার পরিবার।
ব্যারিস্টার সামিরা বলেন, সত্য সূর্যের মতো। একদিন এ সত্য বের হওয়ারই ছিল। তৎকালীন সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বাবার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেছিল। আজকে আদালতের আদেশের মধ্য দিয়ে আমার বাবার মৃত্যুকে ঘিরে যে হয়রানি ও বিভ্রান্তি ছিল তার অবসান হলো। তাকে সম্মানের সঙ্গে পুনরায় দাফনের সুযোগ করে দেওয়ায় আমরা আদালতের কাছে কৃতজ্ঞ।