মেহেরপুর, ০৯ মে (ইউএনবি)- বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে মুজিবনগর। ঐতিহাসিক স্থানটিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় সময় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান তাজউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান মন্ত্রিপরিষদ সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান।

এ অস্থায়ী সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে পরে বৈদ্যনাথতলাকে ঐতিহাসিক মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়।
প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে স্বাধীনতার জন্য জাতির সংগ্রাম সম্পর্কে জনগণকে জানানোর জন্য সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল ঘটনাগুলো তুলে ধরার ভাস্কর্য স্থাপন করা হচ্ছে।

শত কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে নানা অবকাঠামো উন্নয়নসহ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্মৃতি মানচিত্র ও জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে কিছু বহুতল আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেমন- পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পর্যটন মোটেল ও শপিং মল, সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে শিশু পল্লী, ধর্ম মন্ত্রাণালয়ের অর্থায়নে মসজিদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পোস্ট অফিস ও টেলিফোন অফিস, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আভ্যন্তরীন রাস্তা ও হেলিপ্যাড, এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে ৬ দফা ভিত্তিক গোলাপ বাগান নির্মাণ করা হয়েছে।

এখানে নির্মিত মানচিত্রের বুকে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে দেখানো হয়েছে। তার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের বেনাপোল, বনগাঁও, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে শরণার্থী গমন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস, আসম আব্দুর রবের পতাকা উত্তোলন, শাহজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ, শালদাহ নদীতে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ, কাদেরীয়া বাহিনীর জাহাজ দখল ও যুদ্ধ, পাক বাহিনীর সাথে কামালপুর, কুষ্টিয়া ও মীরপুরের সম্মুখ যুদ্ধ, শুভপুর ব্রিজের দুপাড়ের মুখোমুখি যুদ্ধ, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস, পাহাড়তলী ও রাজশাহীতে পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, জাতীয় শহীদ মিনার ধ্বংস, জাতীয় প্রেস ক্লাবে হামলা, সচিবালয়ে আক্রমণ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও জগন্নাথ হলের ধ্বংসযজ্ঞ, তৎকালীন ইপিআর পিলখানায় আক্রমণ, রায়ের বাজার বধ্যভূমি, বুদ্ধিজীবী হত্যা।

মানচিত্রের চর্তুদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের সাহসী নেতৃত্ব ও ভূমিকার ছবিসহ ৪০টি ভাস্কর্য শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মধ্যে তৎকালীন সেনাপ্রধান, উপপ্রধান, বীর উত্তমদের, জাতীয় চার নেতার, তারামন বিবি, সেতারা বেগমের মূর্তমান ছবিসহ ব্রঞ্চের তৈরি ২৯টি আবক্ষ ভাস্কর্য, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ৩০ নেতার তৈলচিত্র রয়েছে।

মানচিত্রের বাইরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রির হত্যাযজ্ঞ, পাক বাহিনীর হাতে নারী নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানি, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল এই মুজিবনগরে দেশের প্রথম সরকারের শপথ ও সালাম গ্রহণ, মেহেরপুরের স্থানীয় ১২ আনসার সদস্য কর্তৃক প্রথম সরকার প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ সরকার প্রধানদের গার্ড অব অনার প্রদান, সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় ১১ জন সেক্টর কমান্ডারদের গোপন বৈঠক, মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের সেক্টর বন্টন সভা, অরোরা নিয়াজী ও একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র নির্মিত ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

মেহেরপুরের সাবেক এমপি ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সাবেক চেয়ারমান প্রফেসর আবদুল মাননান বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের এই অম্লান ও ঐতিহাসিক স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য শেখ হাসিনা মুজিবনগর কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
ভাস্কর্য প্রকল্পের প্রধান ভাস্কর শিল্পী গোপাল চন্দ্র পাল জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মুজিবনগরই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক দেশের একমাত্র বড় দর্শনীয় স্থান হবে। এখানে প্রতিদিন শত শত পর্যটকরা আসে। তারা মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য চিত্র দেখে স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে পারবে।