নির্মাণ কাজের দীর্ঘসূত্রিতায় ইতোমধ্যে প্রকল্প ব্যয় তিনগুনেরও বেশি বেড়েছে। এছাড়াও নির্মাণ ত্রুটির কারণে ছাদ ধসে শ্রমিকের মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে।
এদিকে, দফায় দফায় সময় বৃদ্ধির অনুমোদন নিয়েও কাজ শেষ না হওয়ায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপিত উন্নয়ন প্রস্তাবনায় সংক্ষুব্ধ একনেক সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন: কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে কেন বিলম্ব, জানতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
জানা যায়, ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০১১ সালে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ম্যাটস) ভবনে অস্থায়ীভাবে যাত্রা শুরু হয় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের। ২০১৩ সালে শহরতলীর লাহেনী এলাকায় ২০ একর জায়গার ওপর ২৭৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে নির্মাণ শুরু হয় স্বপ্নের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার সাত বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সীমাহীন অনিয়ম দুর্ণীতি, সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত, স্বাস্থ্য ও সংস্থাপন বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতার সাথে যুক্ত স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে নির্মাণাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ প্রকল্প। ২০২১ সালে এসে এ প্রকল্পের অর্ধেক কাজ হয়েছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ২০০৮ সালের উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব (ডিপিপি) দিয়ে ২০১৩ সালে কাজ শুরু, দুই প্রকৌশলীর দায়িত্বহীনতা, ছোট ছোট প্যাকেজে কাজ ভাগ করা, ছাদ ধসে পড়া, অনিয়মের অভিযোগে কাজ বন্ধ থাকা ও প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতা। গণপূর্ত অফিস, সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের কথায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। শেষ পর্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকল্পের ষষ্ঠবারের সংশোধন আটকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্দেশ দিয়েছেন তদন্তের।
সূত্র জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পৃথকভাবে গঠিত একাধিক দল অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্তে নেমেছে। তদন্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম।
গণপূর্তের যশোর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক ও কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের সুপারভাইজার প্রকৌশলী মানিক লাল দাস বলেন, ‘২০১২ সালের প্রকল্প। আমি আছি গত দুই বছর ধরে। আমার সময়ে প্রকল্প পুনঃনিরীক্ষণ হয়নি, সময় বা অর্থ বৃদ্ধি পায়নি।’
কেন বারবার পুনঃনিরীক্ষণ দরকার হচ্ছে এবং সময় ও অর্থ বাড়াচ্ছে জানতে চাইলে মানিক লাল দাস বলেন, এ ব্যাপারে কুষ্টিয়ার স্থানীয় প্রকৌশলীরা ভালো বলতে পারবেন।
মানিক লাল দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে এ কাজের সাথে থাকলেও তিনি ঠিকমতো সাইট পরিদর্শনে আসেন না। এর আগে, নির্মাণ কাজের অবহেলায় ছাদ ধসের ঘটনায় অনেকের শাস্তি হলেও তিনি থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়া অন্য ঠিকাদারদের যেখানে কাজের মেয়াদ শেষ, সেখানে ঠিকাদার জহুরুল ইসলামের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছেন ২০২২ সাল পর্যন্ত। আর ঠিকাদার জহুরুলের নির্মাণাধীন কাজের অংশেই ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি হাসপাতাল ভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদ ধসে পড়ে। পরে এ প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মের অভিযোগে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী, এসডি, এসওসহ চারজন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। দুইজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এতে কাজে আরও ধীরগতি চলে আসে। পরে ঠিকাদার জহুরুলকে কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও আদালতে রিটে তিনি পার পেয়ে যান।
তবে নিজে কোনো অনিয়মের সাথে জড়িত নন দাবি করে মানিক লাল দাস বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
প্রকৌশলী মানিক লাল দাস বলেন, ‘প্রকল্পের বাজেট-পরিকল্পনা পাস করা এবং টেন্ডার করার দায়িত্ব আমার না। সব ডিপিপি হেড অফিস থেকে করা হয়েছে। এর আগে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) দুইবার দেখেছে, তারা বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন। তবে এই প্রকল্পের শুরু থেকেই সমস্যা আছে। ২০০৮ এর শিডিউল অনুযায়ী প্রকল্প পাস হয় ২০১২ সালে। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২৭৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৩ সালে শিডিউল পরিবর্তন হয়েছে। তখন টেন্ডার করা যাচ্ছিল না। কারণ শিডিউল পরিবর্তন করায় উপকরণের মূল্য বেড়ে যায়। ২০১৪ তে আবার শিডিউল পরিবর্তন হয়। দুই দফায় ব্যয় বেড়ে যায়।’
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের সুপারভাইজার মানিক লালের দাবি, এসব ঘটনায় কোনো কর্মকর্তা এককভাবে দায়ী নন। প্রকল্পের রিভিশন পাস হয়েছে ২০১৮ সালে। এই রিভিশন প্রথমেই অর্থাৎ ২০১২ সালেই পাস করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।
তখনকার যেসব কর্মকর্তা বিশেষ করে কুষ্টিয়া গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন, তার গাফিলতির কারণেই প্রকল্প এত সংকটে পড়েছে। ২০১৩ সালে কাজ শুরুর পর ডিপিপির দর নিয়ে ফাইল চালাচালিতে সময় চলে যায়। কাজের শুরুতেই সব উপকরণের বাজার দর বেড়ে যায়। তাই নকশা অনুয়ায়ী প্রতিটি ভবন শেষ না হতেই বরাদ্দ করা অর্থ ফুরিয়ে যায়। বাজেটের মধ্যে কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। ছয়তলা ভবনের জন্য যে বাজেট দেয়া হয়েছিল, তা দিয়ে নির্মাণ করা হয় চারতলা ভবন। ২০০৮ সালের দর দিয়ে ২০১৩ সালে কাজ শুরু করায় এ সমস্যা দেখা দেয়। তবে বিষয়টি গোপন রাখেন তখনকার কয়েকজন প্রকৌশলী। আইএমইডির নজরে আনার কথা থাকলেও তা না করে কাজ চালিয়ে যান ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা। কাজের মূল্যায়ন করতে পরিদর্শনে এসে আইএমইডির দলের সদস্যরা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে প্রতিবেদন দেন।
তদন্তেই কেটে যায় দুই বছর। এ কারণে অর্থ ছাড়ও বন্ধ হয়ে যায়। তখন এ প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন ডা. ইফতেখার মাহমুদ। তিনি একই সাথে অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি প্রকল্প পরিচালনায় দক্ষ না হওয়ায় গণপূর্ত বিভাগের সাথে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। ২০১২ সালে যখন টেন্ডার আহ্বান করা হয়, তখন কুষ্টিয়া গণপূর্তে নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন শাহিন মিয়া।
গণপূর্ত কার্যালয় থেকে জানা যায়, তিনি সে সময় একসাথে ছয়টি ভবনের টেন্ডার করেন। টেন্ডার শেষে কাজ শুরুর আগেই বিল দেন ঠিকাদারদের। বিল পেয়ে কাজ শুরু করতে গড়িমসি করেন ঠিকাদাররা।
অভিযোগ আছে, তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী শাহিন মিয়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকার বেশি কমিশন নিয়ে ঢাকায় বদলি নিয়ে চলে যান। এরপর যোগ দেন মোহাম্মদ শহিদ কবির। তিনিও কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। ঠিকাদারদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা।
তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী শাহিন মিয়া বলেন, তারা যথাযথ নিয়ম মেনে টেন্ডার করেছিলেন। কোনো অনিয়ম হয়েছে বলে তার জানা নেই।
এই দুই প্রকৌশলী ডিপিপি ক্রয় পরিকল্পনায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে লিমিটেড (এলটিএম) টেন্ডার করেন। ক্রয় পরিকল্পনায় ছিল প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান বা ওপেন (ওটিম) টেন্ডার। এলটিএম টেন্ডার করায় সরকারের খরচ বেড়ে যায়। আর ছোট ছোট প্যাকেজ করার কারণে দেশের নামীদামি ঠিকাদাররা এ কাজে আগ্রহ দেখান নি। এ কারণে যেসব ঠিকাদার কাজ করছেন, তাদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অন্য ঠিকাদাররা।
এদিকে, ২০১৮ সালে নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থছাড় করা হয়। ২০১৯ সালে নতুন করে দায়িত্ব দেয়া হয় তরুণ প্রকৌশলী আরিফুল ইসলামকে। এ কর্মকর্তা যোগ দেয়ার পর দ্রুত কাজ শেষ করা এবং প্রতিটি কাজের মান যাচাই করে বিল দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। তার সময় পুরো চত্বরের বালু ভরাটের কাজ, প্রাচীর নির্মাণ, একাডেমিক ভবন, ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেল, চিসিৎসক ও নার্স ডরমেটরি ও মূল হাসপাতাল ভবনের কাজও প্রায় শেষের দিকে।
গত ১৪ জানুয়ারি লাহিনী এলাকায় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে গিয়ে বিভিন্ন কাজ চলমান দেখতে পাওয়া যায়। তবে, এত বড় প্রকল্পে যে সংখ্যক শ্রমিক কাজ করার কথা তা দেখা যায়নি। ছয়টি প্যাকেজে ২০/২৫ জন করে কাজ করতে দেখা যায়।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবনের পিডি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন করে জমি অধিগ্রহণ ও আরও কিছু ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর আগের যেসব কাজ চলমান তা শেষের পথে। নতুন বছরেই নতুন ক্যাম্পাসে ছোট ছোট করে হলেও সব কার্যক্রম শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি।’
২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরে সংশোধিত প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৭৪২ কোটি টাকা। যা ২০২০ সালের ১২ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় ৬৮২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল এবং মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত করা হয়েছিল। তবে সংশোধিত এ প্রকল্পটি একনেকের বৈঠকে উপস্থাপন করা হলে তা প্রধানমন্ত্রী বাতিল করে তদন্তের নির্দেশ দেন।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের কাজের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রাও।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সরোয়ার জাহান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আশ্বাসের বাণী শুনে শুনে ৯টি বছর কেটে গেছে। এখন আমাদের ৯ম ব্যাচ চলছে। ইতোমধ্যে চারটি ব্যাচ এখান থেকে পাস করে বের হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সেবায় যোগ দিয়েছে। জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকম চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষাদান করতে শিক্ষক এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে আসা শিক্ষার্থীরা নানাবিধ সমস্যার মধ্যে আছে। অস্বাস্থ্যকর, পরিত্যক্ত ও জরাজীর্ণ আবাসনের সংকটে থাকা শিক্ষার্থীরা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ জীবন-যাপন করছে একইভাবে তাদের শিক্ষাদানসহ একাডেমিক কার্যক্রমে প্রাসঙ্গিক আয়োজন সংকুলান করতে পারছি না আমরা।
বিদ্যমান এ পরিস্থিতির সমাধানের দাবি জানান তিনি।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, নির্মাণকালের নির্ধারিত সময় পার করে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে দেয়া কুষ্টিয়াবাসীর স্বপ্নের মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্পটি যাদের কারণে বার বার এমন অনিশ্চিতের হোচট খাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানাচ্ছি। সেই সাথে অবিলম্বে এই প্রকল্পটির নির্মাণ সম্পন্ন করে সীমাহীন কষ্টে থাকা শিক্ষার্থীদের নিজ ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেয়ার আবেদন করছি।