কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার ২৩ বছর অতিবাহিত হলেও, ‘কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর অসহযোগিতার’ কারণে ঐতিহাসিক এ চুক্তির কিছু শর্ত এখনও পূরণ হয়নি।
স্থানীয় ও সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, এ গোষ্ঠীগুলো তিন পার্বত্য জেলাকে আবারও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি স্থাপন এবং দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করা।
কিন্তু তারা বলছেন, সশস্ত্র দলগুলো হত্যা, অপহরণ এবং চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় গত দুই দশকেও পাহাড়ে পুরোপুরি শান্তি ফিরে আসেনি।
চুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল তিন পার্বত্য জেলা- রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। তবে শান্তি চুক্তিবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতার কারণে এ পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে জানান কর্মকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদকালে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার এবং পিসিজেএসএস’র মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য তিন জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটে।
সরকারের পক্ষে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং জনসংহতি সমিতির পক্ষে স্বাক্ষর করেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।
কিন্তু শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৯ সালে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে নতুন জোট গঠন করে একদল জাতিগত সংখ্যালঘু। এরপর ২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতি আরেক দফা ভেঙে সুধা সিন্দু খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএসএস (এমএন লারমা)। সেই অংশটিই স্থানীয়ভাবে জেএসএস’র সংস্কারপন্থী অংশ হিসেবে পরিচিত।
এছাড়া, তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফের সংস্কারবাদী একটি অংশ ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন দল গঠন করে।
চাঁদাবাজি ও হত্যা
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ দলগুলো চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত বলে তথ্য রয়েছে।
তারা জানান, এসব গোষ্ঠী মাঝে মাঝে পাহাড়ি এবং বাঙালি উভয়ের সাথেই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায় এবং উন্নয়ন কাজে বাধা সৃষ্টি করে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, চারটি পার্বত্য সশস্ত্র গোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে স্থানীয় সশস্ত্র দলগুলো নিয়মিত কৌশল পরিবর্তন করছে বলেও জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রাঙামাটি জেলায় কাজ করা শীর্ষস্থানীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে চাঁদা আদায়ের উপায় হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিংকে বেছে নিয়েছে। এ জন্য তাদের শনাক্ত করা এখন কঠিন। যারা চাঁদার অর্থ প্রদান করেন তারাও প্রতিশোধের ভয়ে এ বিষয়ে কথা বলতে চান না।’
আরও পড়ুন: পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে: মন্ত্রী উশৈসিং
টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে সিএইচটি বিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, এ অঞ্চলে চারটি সশস্ত্র দল সক্রিয় রয়েছে, যারা মূলত ‘চাঁদাবাজ’।
জেএসএস’র নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শান্তি চুক্তি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করতে সশস্ত্র দলগুলোকে অবশ্যই অবৈধ অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে।’
তিনি আরও জানান, এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার জন্য সশস্ত্র দলগুলো এখন পার্বত্য জেলাগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ‘টার্গেট’ করছে।
‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তি আনা সম্ভব নয়,’ বলেন দীপংকর।
তিনি বলেন, সিএইচটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে জেএসএসকে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।
‘অন্যথায়, সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে,’ বলেন তিনি।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও সংঘর্ষের মতো বিভিন্ন ঘটনায় ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ১২০ বাঙালিসহ মোট ৩৭৬ জন নিহত হয়েছেন।
এছাড়া, এ সময়ের মধ্যে ১৬৯ বাঙালিসহ ৫৩৬ জনকে অপহরণ করা হয়েছে।
স্থানীয় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, সিএইচটিতে ২০১৯ সালে জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০৫ চাঁদাবাজকে আটক করেছে আইন প্রয়োগকারীরা।
স্থানীয়রা জানান, বাজারে যা কিছু বিক্রি হয় তার জন্য সশস্ত্র দলগুলোকে তাদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয়।
অপরাধ মোকাবিলায় বিপত্তি:
ইউএনবির সাথে আলাপকালে রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর কবির বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান এবং অন্যান্য কারণে অভিযুক্তদের তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার ও হত্যার মামলায় তাদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে কিছু বাধা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেখানে প্রত্যক্ষদর্শী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে সাক্ষ্য দিতে আসার জন্য তিন দিনও সময় লাগে। তারা এটি করতে চায় না। ভাষাগত সমস্যাও যেকোনো তদন্ত ও প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা, কারণ ভিন্ন ভিন্ন আধিবাসী গোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করে।’
‘সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বিজিবি’র সদস্যরা সাধারণত যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করেন এবং চাঁদাবাজি সম্পর্কে কোনো তথ্য পেলে আমরা তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ কারণেই চাঁদাবাজরা নিয়মিত তাদের কৌশল পরিবর্তন করে চলেছে,’ বলেন এসপি কবির।
আরও পড়ুন: সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে বস্তাবন্দী করে রেখেছে: ঊষাতন তালুকদার
তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধীরা এখন সশরীরে না গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চাঁদার টাকা সংগ্রহ করে। তাই আমরা এখন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করি।’
উন্নয়নের পথে বাধা
রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কেবলমাত্র পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে শোষণ এবং সেখানে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য আধিবাসী অনেক নেতা এবং সশস্ত্র দলগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উন্নয়ন এবং পর্যটন শিল্পের বিরোধিতা করে আসছে।
তিনি জানান, জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফের সদস্যরা এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি এবং পর্যটকদের আগমনকে নিরুৎসাহিত করার জন্য পর্যটকবাহী যানবাহনগুলোতে বিভিন্ন সময় আক্রমণ চালানো ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।