পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন পুনরায় উল্লেখ করেছেন যে আদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকার এ মুজিববর্ষেই অন্ততপক্ষে বঙ্গবন্ধুর আরও এক খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে।
‘এটি আমাদের আশা’ উল্লেখ করে তিনি হত্যাকারীদের একজন সাবেক ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের ফাঁসি সম্প্রতি কার্যকর করা হয়েছে বলেও যোগ করেন।
পলাতকরা হলেন- কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব্যাহতি প্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব,) নূর চৌধুরী, মেজর (অব.) রাশেদ চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিন খান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আঠারো সদস্যকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন- ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল এবং দশ বছর বয়সী শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল এবং রোজি জামাল, ভাই শেখ আবু নাসের, কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মনি এবং তার গর্ভবতী স্ত্রী আরজু মনি, শিশু সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ ও আবদুল নাঈম খান রিন্টুসহ আরও কয়েকজন।
বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিলকেও সেদিন হত্যা করা হয়েছিল।
এছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় একই দিনে খুনিদের চালানো কামানের গোলায় একই পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য মারা যান।
জাতির জনকের বাকি পাঁচ পলাতক দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের রায় কার্যকর করতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীদেরও সমর্থন চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত সাবেক ১২ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
খুনিরা: কে কোথায়
পলাতকদের মধ্যে নূর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরীর অবস্থান জানা গেলেও রশিদ, ডালিম এবং মোসলেহউদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নয় সরকার।
নূর চৌধুরী এখন কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন।
ডালিম ও মোসলেহউদ্দিন যথাক্রমে স্পেন এবং জার্মানিতে আত্মগোপন করে আছেন বলে ধারণা করা হয়।
সরকার বঙ্গবন্ধুর পাঁচ পলাতক খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘পাঁচ আসামিকে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের (মৃত্যুর) সাজা কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম খুনি যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রাশেদ চৌধুরীর মার্কিন সুরক্ষা প্রত্যাহার করা হতে পারে বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায় দেশটির একটি সংবাদমাধ্যম।
বাংলাদেশ যখন রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জার্নাল পলিটিকো ‘তিনি ভেবেছিলেন আশ্রয়ে আছেন, এখন তিনি মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশেদ চৌধুরী তার বর্তমান সুরক্ষা এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আশ্রয় হারাতে পারেন।
মার্কিন অনলাইন পোর্টাল পলিটিকোর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৭ জুন নীরবে মামলাটি পুনরায় সচল করার উদ্যোগ নেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল বিল বার।
আইনজীবীদের বরাতে পলিটিকোর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১৫ বছর ধরে মামলাটি বন্ধ ছিল। তবে এখন তা বারের কল্যাণে পুনরায় ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যে আইন আছে তা রাশেদ চৌধুরী ভেঙেছেন কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের এ উদ্যোগ গুরুতর অপরাধ করে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়া অনেকের জন্য একটি কড়া বার্তা, যা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়ার পরও যেকোনো মামলা পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং আইনি নথির ওপর ভিত্তি করে পলিটিকোর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বারের এমন পদক্ষেপে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে আনন্দিত হবে কারণ রাশেদ চৌধুরীকে হস্তান্তর করার জন্য দেশটির সরকার বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করা রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর জন্য দেশটির প্রতি বিভিন্ন সময়ে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
কেন হত্যাকাণ্ড হয়েছিল?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্র বঙ্গবন্ধুকে এমন এক সময়ে হত্যা করেছিল যখন তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করে পুরো জাতিকে সাথে নিয়ে ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত বাহিনী বাঙালি জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অগ্রগতি নষ্ট করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল।
শুক্রবার এক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, হত্যাকারীদের লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে দেয়া এবং আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা বানচাল করা।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরপরই হত্যা, অভ্যুত্থান এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এ বিচার বন্ধ করে দিয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, খুনিদের শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজকেও তারা বাধাগ্রস্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন এবং গণতন্ত্রকে অপমান ও সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন জারি করেছিলেন।
জিয়া জাতির পিতার হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে তাদের বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপরাধীদের জাতীয়তা দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশীদার করেছেন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে তাদের পুনর্বাসিত করেছেন, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।