ভরা মৌসুমে দিনে ৮০ টন কচুর লতি বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন বরুড়ার কচু ব্যাপারীরা। আর উৎপাদিত লতির ১০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হয় বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বরুড়ায় কচুর লতির চাষ হলেও গত তিন বছর ধরে বিদেশে লতি রপ্তানি হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে অনেক বেশি মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে এ পেশায়। ধান চাষে লাভ তুলনামূলক কম ও ঝুঁকি থাকায়, লতি ও অন্যান্য শাকসবজি চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন এখানকার কৃষকরা।
উপজেলার আগানগর, ভবানীপুর ও দক্ষিণ খোশবাস ইউনিয়নে বেশি কচু চাষ হয়। অন্যান্য ইউপিতে কচুর চাষ হলেও তা তুলনামূলক কম। এ উপজেলায় দুই ধরনের কচু বেশি চাষ হয়। একটি কচু লতি (কচু রাজ) আর অন্যটি পানি কচু (স্থানীয় ভাষায় বরিশাইল্যা কচু)।
আরও পড়ুন: ভাসমান সবজি চাষে সাবলম্বী খুলনার ভূমিহীন কৃষকরা
সবজি চাষে স্বাবলম্বী মাদারীপুরের সোহেল
কচু রাজে শুধুমাত্র লতি হয়। পানি কচুর লতি ও লতির ফলন শেষ হলে পুরো গাছসহ বিক্রি হয়। অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝিতে বরুড়ায় রোপণ শুরু হয় কচু গাছের। মাঘ মাস পর্যন্ত ধাপে ধাপে রোপণ করা হয় কচু গাছ। লতি রাজের চেয়ে পানি কচু রোপণ শুরু হয় তাড়াতাড়ি। ফলন শুরু হওয়ার পর একটানা ৮ মাস লতি পাওয়া যায়। মাঘ মাসে লতি কিছুটা কম পাওয়া গেলেও চৈত্র মাসে এর ফলন দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়। শীতকালীন সবজির আধিক্য কমে যাওয়ায় এসময়ে দামও পাওয়া যায় বেশি।
কৃষকরা জানিয়েছেন, সব মৌসুম মিলিয়ে গড়ে প্রতি কেজি লতির দাম পড়ে ২৫ টাকা করে, গাছসহ কচুর দাম পড়ে প্রতি কেজি ২০ টাকা করে। কচুর লতি চাষে প্রতি শতকে খরচ পড়ে ৮০০ টাকা, পানি কচু চাষে প্রতি শতকে খরচ পড়ে এক হাজার টাকা।
বরুড়া উপজেলার দুই হাজার কৃষক কচু চাষের সাথে সম্পৃক্ত। পুরুষদের পাশাপাশি অনেক নারীরও কর্মসংস্থান হচ্ছে কচু চাষের মাধ্যমে। স্থানীয় কৃষকরা লতি তুলে বাড়িতে নেন, সে লতি পরিষ্কার করে আটি বাঁধেন নারীরা। আটি বাঁধা শেষ হলে স্থানীয় ব্যাপারীরা নগদ টাকা দিয়ে লতি কিনে নেন। তারপর ছোট ছোট ভ্যানে করে উপজেলার বিজয়পুর, আড়াওটি, বাতাইছড়ি, সরাপতি, মুগুজি, বারইপুর গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে স্তুপ করা হয়। সেখান থেকে পিকআপ ভ্যানে করে কচুর লতি নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম ও কৃমিল্লার নিমসারের আড়তদারদের কাছে।
ছোট-বড় ৫০ জন ব্যাপারী কচুর লতি সংগ্রহ করেন। কুমিল্লার বুড়িচংয়ের নিমসারে কচুর লতি বিক্রি করার জন্য আলাদা কর্নার রয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকার আড়তদারদের কাছে বিক্রি হওয়া লতির একটি অংশ অ্যাজেন্সির মাধ্যমে চলে যায় ইতালি, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে। ইতালি ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল দেশে কুমিল্লার বরুড়ার লতির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে দিনে একটন লতি বিদেশে রপ্তানি হয় বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: বগুড়ায় আগাম সবজি চাষে ব্যস্ত চাষিরা
কুড়িগ্রামে বন্যার ক্ষতি পোষাতে আগাম সবজি চাষ
ধানের পরিবর্তে সবজি চাষে আগ্রহ বাড়ছে ডুমুরিয়ার চাষিদের
এছাড়া কুমিল্লা থেকে ২০২০ সালে দেড় লাখ চারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়েছে। ২০২১ সালে এক লাখ চারা বিক্রি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লতি রাজের চারা ৩ টাকা ও পানি কচুর চার ৪ টাকায় বিক্রি হয়। চারা রোপণের পর ভাদ্র মাসে গাছের মূল থেকে নতুন চারা গজায়। সে চারা বিক্রি হয়, আবার একই চারা দিয়ে বরুড়ার কৃষকরা নতুন নতুন জমি আবাদ করেন।
বরুড়ার আগানগরের কৃষক সেলিম মিয়া ৫০ বছর ধরে কচু চাষ করেন। এবার ১৭ শতক জমিতে কচু রাজ লাগিয়েছেন তিনি। খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
তিনি বলে, ‘এ জমি থেকে ৩০ হাজার টাকার লতি বিক্রি করব। কচু চাষে লোকসান হয় না বললেই চলে, ফলনও হয় লম্বা সময় ধরে। তাই কচু চাষ করছি।’
উপজেলার দক্ষিণ জগদেশর গ্রামের কৃষক সানাউল্লাহ বলেন, ’১৮ শতক জমিতে পানি কচু চাষ করেছি। ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সবমিলিয়ে ৬০ হাজার টাকার লতি ও গাছ বিক্রি করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘সহজে কৃষি ঋণ পেলে ও কৃষি কর্মকর্তাদের আরও আন্তরিকতা থাকলে এ পেশায় আরও বেশি মানুষ সম্পৃক্ত হত।’
আড়াওটি গ্রামের ব্যাপারী ছফিউল্লাহ জানান, এখন অফ সিজন, তারপরও দিনে আড়াই টন কচুর লতি চট্টগ্রামের আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন তিনি। একমাস পর ভরা মৌসুম আসলে দাম ও বিক্রি দুটোই বাড়বে।
চট্টগ্রামের আড়তদার রাসেল আহমেদ বলেন, ‘এখন একটন লতি রপ্তানি হচ্ছে। ভরা মৌসুমে রপ্তানি বাড়বে।’
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইংয়ের উপ পরিচালক শৈবাল কান্তি দাশ জানান, এ বিমানবন্দর দিয়ে প্রতি বছর ২০০ টন কচুর লতি বিদেশে রপ্তানি হয়। বেশি রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যে।
আরও পড়ুন: ‘চোরাচালান’ ছেড়ে শার্শা সীমান্তে সবজি চাষে ঝুঁকছেন অনেকেই
সবজি চাষে স্বাবলম্বী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষক মহিউদ্দিন
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের কন্দাল (মাটির নিচে যেসব উদ্ভিদের ফলন হয়) প্রকল্পের অধীনে বরুড়ার কচু চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথমে কম সংখ্যক চাষিকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। ধীরে ধীরে অন্যান্য চাষিদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হবে। মূলত বেশি ফলন ও বিষ প্রয়োগ না করে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদের মাধ্যমে কীভাবে পোকামাকড় দমন করা যায়, সে বিষয়ে কৃষকদের দক্ষ করে তোলা হবে। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
বরুড়া উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকরা চাইলে তাদের জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা করব। উপজেলার নারী-পুরুষ সবাই এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে।’
বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘বরুড়া বাংলাদেশের কৃষিতে দারুণ ভূমিকা রাখছে। কচুর লতি রপ্তানি ও বিপণন বিষয়ে কৃষকদের সর্বোচ্চ সহায়তা করবে উপজেলা প্রশাসন।’