ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক কেবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে। আমি এই মুহূর্তে কোনো বড় পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না।’
রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, নতুন প্রশাসনের নীতিগুলো কী তা দেখতে হবে এবং উল্লেখ করেন যে মন্ত্রিপরিষদের পদগুলোতে যারা যাবেন তাদের অনেকেই তার সুপরিচিত।
‘তাদের অনেকেরই ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে প্রকৃত মনোযোগ রয়েছে,’ বলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
কসমস সেন্টারে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রদর্শনী দেখলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) এগিয়ে নেবেন কিনা জানতে চাইলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যিনি ইউএস মেরিন কর্পস অফিসার হিসেবেও দায়িত্বও পালন করেছেন, বলেন, ‘আমারও তাই মনে হয়। এটিকে যেভাবেই বলা হোক বা যেভাবেই রিব্রান্ড করা হোক না কেন, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ খুব দৃঢ় থাকবে।’
বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্প ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাকে তার প্রশাসনের অন্যতম সর্বোচ্চ গুরুত্বের স্থানে রেখেছিলেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ভিয়েতনামে তিনি একটি মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের রূপরেখা দিয়েছিলেন, যেখানে সকল দেশ একসাথে সার্বভৌম, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সমৃদ্ধ হবে।
ন্যায্য ও পারস্পরিক বাণিজ্য, উন্মুক্ত বিনিয়োগের পরিবেশ, সুশাসন এবং সমুদ্রের স্বাধীনতা হলো তাদের লক্ষ্য যারা মুক্ত ও উন্মুক্ত ভবিষ্যতে উন্নতি করতে চায়।
রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, ‘আমি আইপিএসকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিরোধী হিসেবে দেখছি না। আইপিএস হলো মার্কিন যুক্তিবাদ যে এ অঞ্চলটি সুশাসনের নীতি দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত।’
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও জোরদার হবে: রাষ্ট্রদূত মিলার
তিনি আরও বলেন, কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো অবশ্যই লাভবান হতে পারে কারণ এখানে অপার সম্ভাবনা রয়েছে এবং বিনিয়োগকারীরা এজন্য বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর দিকে নজর রাখবেন।
মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি
রাষ্ট্রদূত মিলার বলেছেন, পরিস্থিতি তৈরির জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে যাতে সকল রোহিঙ্গা ‘নিরাপদে, মর্যাদার সাথে এবং স্বেচ্ছায়’ নিজ দেশে ফিরতে পারে এবং শিগগিরই তা শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশ বলেছে, যদি ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ না দেয়া হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা ‘আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে বিপদের মুখে ফেলবে’।
আগামী ১৯ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ঢাকায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করবে বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং চীন কারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনকে এই সঙ্কটের একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখছে ঢাকা।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র: মিলার
ত্রিপক্ষীয় এ প্রক্রিয়া সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, এই সঙ্কট সমাধানে যেকোনো দেশ সহায়তা করতে পারে এবং এটি কার্যকর।
জেনেভা ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এবং রোহিঙ্গাদের সমর্থন করার ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও সোচ্চার দেখতে চায় উল্লেখ করে মিলার বলেন, ‘চাপটা মিয়ানমারের উপর থাকতে হবে। এই বিশাল বোঝা বাংলাদেশ বহন করবে এটি ন্যায়সঙ্গত নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এমন অনেক দাতা আছেন যারা এগিয়ে এসেছেন। অন্যরাও আমাদের সাথে যোগ দেবে আশা করি।’
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সঙ্কটের প্রতিক্রিয়ায় মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে অগ্রণী অবদান রেখে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালের আগস্টে সহিংসতা বৃদ্ধির পর থেকে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে দেশটি, যার মধ্যে প্রায় ৯৬২ মিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কর্মসূচির জন্য।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের মতো সাহস দেখাতে হবে: মিলার
নিপীড়িত সম্প্রদায়ের (রোহিঙ্গা) জন্য সীমানা খুলে দিয়ে বিশ্বে একটি উদাহরণ স্থাপন করায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের আরও শক্তিশালী অংশীদার এবং সমর্থক হিসেবে সহায়তা (রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায়) অব্যাহত রাখব।’
জনগণের সাথে জনগণের বন্ধন
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে তারা নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
‘বাইডেন প্রশাসনের অধীনেও এটি অব্যাহত থাকবে,’ বলেন তিনি।
রাষ্ট্রদূত মিলার তৎকালীন মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির কথা উল্লেখ করেন যিনি ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন জনগণের সাথে জনসম্পর্ক সম্পর্কের প্রতি আলোকপাত করে।
রাষ্ট্রদূত মিলার সেনেটর কেনেডির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মূল পররাষ্ট্রনীতি হলো নাগরিকের সাথে নাগরিক, বন্ধুর সাথে বন্ধু, জনগণের সাথে জনগণের এবং ভ্রাতৃত্বের বিদেশি বন্ধন যা কোনো দৌরাত্মেই হ্রাস পায় না।’
সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যাহত থাকবে: মিলার
রাষ্ট্রদূত বলেন, এই বছরটি সবার জন্য অপার সম্ভাবনা এবং সুযোগের কারণ বাংলাদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন করছে এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবে অসাধারণ এই দেশটি।
রাষ্ট্রদূত মিলার জানান, গত পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের অসাধারণ যাত্রার প্রশংসা করার সর্বোত্তম উপায় নিয়ে ভাবছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
‘আমাদের বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে,’ বলেন তিনি।
রাষ্ট্রদূত মিলার তরুণদের সাথে সম্পৃক্ত থাকার উপর জোর দেন এবং উল্লেখ করেন যে স্মরণ এবং উদযাপনের এই সময়ে এটি হবে তাদের দুর্দান্ত সুযোগগুলোর মধ্যে একটি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের মতো এতো কর্মচাঞ্চল্য এবং ভবিষ্যতের জন্য উৎসাহ তিনি কখনো কোনো দেশে দেখেননি।
রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, ‘বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসের সুপারস্টার।’
বঙ্গবন্ধুর প্রতি রাষ্ট্রদূত মিলারের শ্রদ্ধা নিবেদন
তিনি বলেন, বিশ্ব বাংলাদেশের মতো দেশের গুরুত্ব সম্পর্কে আরও সচেতন হচ্ছে, কেবলমাত্র এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বা অবস্থানের জন্য নয়, এখানে যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তার জন্য।
‘বাংলাদেশে এখন কী ঘটছে এবং ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে সেটিও চিত্তাকর্ষক,’ বলেন মিলার।
করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মহামারি মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে ৬৮.৭ মিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে।
বাংলাদেশ চলতি বছরের মার্চে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবে এবং ২০২২ সালে বাংলাদেশ-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপনের অপেক্ষায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ।
শান্তি, সমৃদ্ধি এবং একটি মুক্ত, ও সুরক্ষিত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য সুরক্ষা, উন্নয়ন, বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও জ্বালানি খাতে যৌথ প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র।