বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের পর পেরিয়েছে প্রায় দুই যুগ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন শিকড় গেঁড়ে বসেছে এ রোগের ভাইরাস। চরিত্র পাল্টে আরও শক্তিশালী হয়েছে ডেঙ্গুর ভাইরাস বহনকারী মশা এডিস। ২০১৯ সালেই ভয়াবহ রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল ডেঙ্গু। সেই ভয়াবহতাও অতিক্রম করেছে চলতি বছর। তবে রোগ নির্মূলে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার গ্লানিই বয়ে বেড়াচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে গবেষণার ঘাটতি, ভুল ও অপরিপকল্পিত নগরায়ণ, কর্মপরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার অভাব এবং বৃহৎ পরিসরে জনগণকে সম্পৃক্ততার ব্যর্থতার কথা বলেছেন চিকিৎসক, গবেষক, কীটতত্ত্ববিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, কোনো একটি রোগ প্রতিরোধ বা নির্মূল করতে চাইলে গবেষণাই প্রধান ও প্রথম উপায়। গবেষণা আমাদের পথ দেখায় এবং শত্রুকে চিনিয়ে দেয়। তাই গবেষণা ব্যতিরেকে ডেঙ্গুর মতো একটি রোগ প্রতিরোধের কাথা চিন্তা করা অন্ধের পথ হাঁটার মতো।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে কাতর রাজধানী, হাসপাতালে সিট সংকট
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর সঙ্গে তিনটি বিষয় ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা দেশে আসলে খুবই কম হচ্ছে। যেমন ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন, এটি কাদের বেশি আক্রমণ করে, এ ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট জটিলতাগুলো এবং পূর্ববর্তী অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলে কী হতে পারে- এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না। অন্য দিকে এ ভাইরাসের যে টিকা সেক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ন্যূনতম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
লেনিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে অন্য ধরনের এডিস মশাও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। কতভাগ অন্য এডিস মশা আর কতভাগ আবাসিক বা ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, এর উপরেও তেমন কোনো গবেষণা করা হচ্ছে না।
এডিস মশার চরিত্র বদল, প্রজননস্থল পরিবর্তন হয়েছে এবং রোগের উপসর্গও বদলেছে। এ বিষয়ে ব্যাপক পরিধিতে এবং বহুকেন্দ্রে যে গবেষণা করা দরকার সেটিও হচ্ছে না বলে দাবি করেন এ চিকিৎসক।
তিনি বলেন, এটিকে প্রতিরোধের জন্য তিন ধরনের গবেষণা দরকার। প্রাক-গবেষণা, প্রাদুর্ভাব চলাকালীন গবেষণা ও পরবর্তী গবেষণা। সেগুলোর কোনোটাই হচ্ছে না।
গবেষণা ঘাটতির কথা উল্লেখ করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা কতটা কার্যকর হচ্ছে সেটার ওপরও গবেষণা দরকার। ডেঙ্গুর চরিত্র পরিবর্তনের বিষয়েও বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা দরকার। সিটি করপোরেশনের তো সেইভাবে ডেডিকেটেড কীটতত্ববিদ দেখি না বা কোনো একটি গবেষণা সেল আছে যারা সারা বছর গবেষণা করছে। এখন তো ডেঙ্গু শুধু বর্ষাকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
গবেষণা ঘাটতির পাশাপাশি নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতার কথাও জানালেন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব।
তিনি বলেন, ‘নগর পরিকল্পনার ভিত্তিতে জনগণের মাত্রাকে অন্তর্ভুক্তিতে এনে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া কোনো পথ নেই। আমাদের সড়কগুলো উঁচু ও একই উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে। একারণে পূর্বে ও পশ্চিমে কিছু জায়গায় অল্প বৃষ্টিতে পকেটে জল আটকে থাকে। যেগুলোকে জলের থিরতা বা অনেকে জলজট বা জলাবদ্ধতা বলে। জুরাইনের আশপাশের অঞ্চল, কলাবাগান, কাঠালবাগান অঞ্চলজুড়ে এরকম অসংখ্য জায়গায় পানি আটকে থাকছে এবং ডেঙ্গুর লার্ভার প্রজনন স্থল গড়ে উঠেছে।’
চার বছরে নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে অভিযান চালানোর পর এডিসের লার্ভা ৫০ থেকে নেমে ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে বেসমেন্টে বেশি এডিস মশার উপস্থিতি দেখা গেছে। এটিকে ত্রুটিযুক্ত নির্মাণ ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন এই স্থপতি।
এ ছাড়া জলবায়ুর পবির্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে সরাসরি ডেঙ্গুর সম্পর্ক আছে বলে জানান তিনি।
এই স্থপতি বলেন, তিন-চার বছর আগের বর্ষা আর এখনকার বর্ষার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। লাগাতার বৃষ্টি না হয়ে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়া এবং মাঝে মাঝে তীব্র খরা এডিস লার্ভার প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ।
নগরপরিকল্পনার ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, যেকোনো নগরের জন্য সবুজ, জলাধার ও ধুসর এলাকার সমন্বয় দরকার। কিন্তু আমাদের শহরগুলোর সবুজ ধ্বংস করা হচ্ছে, জলাধার নষ্ট করা হচ্ছে। আর ধুসর অংশ বা কংক্রিটের পরিমাণ বাড়ছে। এতে উষ্ণায়ন বাড়ছে। যা ডেঙ্গুর বিস্তারের জন্য খুবই উপযুক্ত পরিবেশ।
তিনি আরও বলেন, রাজধানীর জলাধারগুলো যেভাবে পরিষ্কার করার কথা বা পানির প্রবাহামনতা ফিরিয়ে আনার জন্য যে কাজগুলো হয় তা খুবই স্বল্প পরিমাণে। এ ছাড়া অনেক জায়গায় খালগুলো মেরে ফেলা হয়েছে।
প্রথম দিকে সিটি করপোরেশন যেভাবে খালগুলো উদ্ধারে কাজ করছিল সেগুলো পরে স্তিমিত হয়ে গেছে বলে দাবি করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।
তিনি বলেন, প্রচুর কালভার্ট আছে যেগুলো ময়লা-আবর্জনা জমে পানির প্রবাহমানতা নষ্ট হয়েছে। আসলে নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে যে পরিকল্পনা দরকার, সেটি একদমই নেই।
কোলকাতার সফলতার উদাহরণ টেনে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ফগিং নির্ভরতা থেকে থেকে বের হয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করতে হবে। আবার নগর পরিকল্পনার যেসব ভুলের কারণে মশার উৎপাদন বেড়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। বক্স কালভার্ট বা খালগুলোর প্রবাহমানতা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়মগুলো মানতে হবে। সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলার কথা বলেছেন এই দুই পরিকল্পনাবিদ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ব্যবহার করে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণের উপর গুরুত্ব দেন তারা।
একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে আত্মতৃপ্তি ও আত্মস্লাঘা থেকে সরে আসার আহ্বানও জানান।
সেই সঙ্গে গ্রহণযোগ্য ভ্যাক্সিন থাকলে তার ব্যবস্থাও করতে হবে বলে মন্তব্য করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব।
জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মানুষের আচরণ, জনসংখ্যার বৃদ্ধি, পানির সমস্যার কারণে পানি জমিয়ে রাখা নানা কারণে ডেঙ্গু বাড়ছে। এটি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী ভ্যাক্সিন নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৭-৮ ধরনের ভ্যাক্সিন নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ডেন ভ্যাক্সিয়া। এটি শুধু ৯-৪৫ বছরের মানুষকে দেওয়া যাবে এবং আক্রান্ত হওয়ার আগে দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, এটি প্রয়োগের আগে পরীক্ষা করে নিতে হবে আগে আক্রান্ত হয়েছিল কি না। এই পরীক্ষায় ভুল হলে বিপদ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া গর্ভবতী বা স্তন্যদাতা মায়েদের দেওয়া যাবে কি না বা দিলে কোনো ক্ষতি হবে কি না সে বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।
জাপানের তাগেদা ফাউন্ডেশনের তৈরি কিউডেংকা ভ্যাক্সিনেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে জানান এই গবেষক।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু ভ্যাক্সিন না আসার কারণে দায়ী ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ ডেন-১,২,৩,৪। যখন এর ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ করা হয়, তখন এর চার সেরোটাইপ একসঙ্গে নিয়ে আসতে হয়। এ কারণে ডেঙ্গু ভ্যাক্সিন সফলভাবে তৈরি করা এবং মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা কঠিন।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট
মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ডেন ভ্যাক্সিয়া খুব বেশি কার্যকরী নয়। বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতা এখনো তৈরি হয়নি। এ ছাড়া এটি এখনো অনুমোদিত নয়।
দেশে ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিব ডেঙ্গুর জন্য গবেষণা সেল তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। ডেঙ্গু যেহেতু যাচ্ছে না, সেজন্য একটি গবেষণা সেল তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন। এবার ব্যাপকভাবে গবেষণা শুরু হয়ে যাবে। এ ছাড়া আমাদের গবেষণার জন্য তো রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) রয়েছে। ওখানেও কাজ হচ্ছে।
ডেঙ্গু জ্বর ও এর বহনকারী ভাইরাস বা এডিস মশা নিয়ে কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহ্মিনা শিরীন ইএনবিকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর কিছু জটিলতা দেখা দেয়। সেগুলো দেখার জন্য প্রতি বছর সেরোটাইপ করা হয়। বিগত বছরগুলোতে সেরোটাইপে যেভাবে পরিবর্তন আসছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার থেকে অনেক দ্রুত পরিবর্তন আসছে। এই জায়গাগুলোতে কাজ করছি আমরা।
তিনি বলেন, এবছরের শুরুতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কীটতত্ববিষয়ক জরিপ করেছে। সংবাদ সম্মেলন করে বলে দিয়েছে এবার ভয়াবহতা বাড়বে। বিভিন্ন অঞ্চলে মশার ঘনত্ব বেড়েছে। কোন কোন অঞ্চলে বেশি ঘনত্ব ছিল তা তারা চিহ্নিত করেছে। এসব নিয়ে কিছু কিছু কাজ হয়েছে।
আরও পড়ুন: এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৩০০ ছাড়াল
এডিস মশার বৈশিষ্ট্য, প্রজনন ক্ষেত্র, রোগের উপসর্গ পরিবর্তন হয়েছে এসব বিষয় নিয়ে আইইডিসিআর থেকে কোনো গবেষণা হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. তাহ্মিনা বলেন, এ বিষয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখাই গবেষণা করে। কীটতত্ত্ববিষয়ক গবেষণা আমরা করি না। এখন পর্যন্ত কিরিনি। তবে ভবিষ্যতে চিন্তা আছে, যদি সুযোগ হয় তাহলে আমরা করব। যেহেতু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যেই রয়েছে। এটা উনারাই করছে।
তিনি আরও বলেন, রোগের তীব্রতা কেন বাড়ছে- এখানে আমাদের গবেষণার একটা জায়গা আছে। মশা নিয়ে গবেষণা মূলত কীটতত্ত্ববিদেরাই করেন।
আইইডিসিআর ডেঙ্গুর কোন বিষয়গুলো গবেষণা করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কীটনাশকগুলো বাজারে আছে বা ব্যবহার হচ্ছে সেটার কার্যকারিতা দেখে আইইডিসিআর।
কীটতত্ত্ববিদ, নগরপরিকল্পনাবিদ ও চিকিৎসকরা অভিযোগ করেছেন কর্ম পরিকল্পনা, জরিপ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ কয়েকটি বিষয়ে সমন্বয় ও গবেষণার ঘাটতিও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পেছনে একটি বড় কারণ। এসব বিষয়ে সমন্বয় কতটা সম্ভব হচ্ছে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। এ বিষয়ে আরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কথা বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।
সামগ্রিকভাবে ডেঙ্গু নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা কতটা হয়েছে জানতে চাইলে ডা. তাহ্মিনা শিরীন বলেন, ‘খুব বেশি যে এগিয়েছি আমরা তা বলতে পারি না। তবে কিছু কিছু কাজ হচ্ছে।’