ইরানে পুলিশের হাতে বন্দি মাহসা আমিনি (২২) নামের এক তরুণী মৃত্যুর ঘটনায় দেশটিতে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা ৯ জনে পৌঁছেছে। বৃহস্পতিবার অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
অন্যদিকে বিক্ষোভের জেরে বুধবার ইরানজুড়ে নাগরিকেরা প্রায় সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের শিকার হন।
যদিও এর আগেই ইরানের একজন কর্মকর্তা এমন পদক্ষেপ নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন যে নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে এমন ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।
অন্যদিকে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে জনগণের পক্ষে বিক্ষোভ সংগঠিত করা এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়নের তথ্য শেয়ার করা আরও কঠিন হবে।
নিহত আমেনিকে বাধ্যতামূলক ইসলামী পোশাক মাথার স্কার্ফ খুব ঢিলেঢালাভাবে পরার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল।
তার মৃত্যুর পর থেকেই দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং দেশটিতে বিদ্যমান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের পতনের আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বুধবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়ার সময়ও বিক্ষোভ চলছিল।
বুধবার পঞ্চম দিনের মতো রাজধানী তেহরানসহ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
আরও পড়ুন: পরমাণু চুক্তি আলোচনায় ‘লিখিত প্রতিক্রিয়া’ পেশ ইরানের
দেশটির আধা-সরকারি ফার্স নিউজ এজেন্সি অনুসারে, সেখানে পুলিশ ‘স্বৈরশাসকের মৃত্যু চাই’ এবং ‘যে আমার বোনকে হত্যা করেছে তাকে আমি হত্যা করব’ বলে স্লোগান দিতে থাকা বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে।
লন্ডন-ভিত্তিক অধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনী লাঠিপেটা, ছররাগুলি, টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করেছে। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত চারজনসহ সংঘর্ষে আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এসময় আরও শতাধিক আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইরানি কর্মকর্তারা তিনজনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছেন। তারা এ সকল মৃত্যুর জন্য অজ্ঞাত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছেন।
বুধবার মধ্যরাতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তারা তাদের মোবাইলে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করতে পারছেন না।
ইনকর্পোরেটেড নামের কেন্টিকের একটি নেটওয়ার্ক ইন্টেলিজেন্স কোম্পানির ইন্টারনেট বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক ডগ মাডোরি বুধবার মধ্যরাতে বলেছেন, ‘আমরা গত কয়েক ঘন্টার মধ্যে ইরানে মোবাইল ডেটাসহ ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ দেখতে পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি সম্ভবত দেশটির সরকারের নেয়া পদক্ষেপ।’
আরও পড়ুন: ইরানে বন্যায় ২১ জন নিহত, ৩ জন নিখোঁজ
ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নিরীক্ষণকারী লন্ডন-ভিত্তিক একটি গ্রুপ নেটব্লকস এর আগেই ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ দুই ক্ষেত্রেই নেটওয়ার্কে বিঘ্নের কথা জানিয়েছে।’
ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা বলেছে, তারা সচেতন যে ইরানিরা ইন্টারনেটে অ্যাক্সেস করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এক বিবৃতিতে মেটা জানায়, ‘আমরা আশা করি দ্রুতই তারা তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকার ফিরে পাবে।’
এর আগে বুধবার ইরানের টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ইসা জারেপুর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘নিরাপত্তা সমস্যার কারণে’- কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে।
আমিনির মৃত্যুতে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
পুলিশ জানায়, নিহত আমেনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন এবং তার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করা হয়নি।
তবে তার পরিবার পুলিশের দাবি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছে, আমেনির হার্টের কোনো সমস্যা ছিল না এবং পুলিশ তাদেরকে আমেনির লাশ দেখতে বাধা দিয়েছে।
বুধবার বিবিসি পার্সিয়ানের কাছে টেলিফোনে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে নিহতের বাবা আমজাদ আমিনি তার মেয়ের মৃত্যুর বিষয়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলার অভিযোগ করেছেন। যতবারই তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন কিভাবে তার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে, লাইনটি রহস্যজনকভাবে কেটে দেয়া হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বলেছে যে দেশটির মোরাল পুলিশ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অভিযান জোরদার করেছে এবং নারীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা চালাচ্ছে।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট রাইসি, আমিনির মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ইরানে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ৫ জনের মৃত্যু
ইরানের কর্মকর্তারা বিক্ষোভের জন্য নাম প্রকাশ না করে বিদেশি শক্তিগুলোকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন এসব দেশ মিথ্যা বলে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
পারমাণবিক কর্মসূচি চালানোর অভিযোগে পশ্চিমাদের আরোপিত বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানে বিক্ষোভ বাড়ছে।
বাইডেন প্রশাসন ও তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমাদের দাবি পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ সংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ রয়েছে।
জাতিসংঘে তার বক্তৃতায় রাইসি বলেন, ইরান পরমাণু চুক্তির শর্ত মেনে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে তারা কোনও চুক্তিতে আমেরিকার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করতে পারে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ইরান জোর দিয়ে বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে। ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি প্রত্যাহার করার পরে ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত ইরানে বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট উচ্চ-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে।