যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাউই শহরে দাবানলে পুড়ে কমপক্ষে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) এ তথ্য নিশ্চিত করে হাওয়াইয়ের গভর্নর জোশ গ্রিন বলেন, ‘কয়েকটি জায়গা ছাড়া পুরো লাহাইনা পুড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, আগুনে এক হাজারেরও বেশি স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলো এখনও জ্বলছে।
গ্রিন আরও বলেন, আমরা মর্মাহত। ১৯৬০ সালের সুনামিতে বিগ আইল্যান্ডে ৬১ জন নিহত হওয়ার পর এটিই দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সরকারি হিসাবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫৩। তবে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
গত মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) উত্তপ্ত গ্রীষ্মকাল এবং একটি ক্ষণস্থায়ী হারিকেনের প্রবল বাতাস থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। মাউইবাসীকে অবাক করে দিয়ে মুহূর্তে দ্বীপের বাড়িঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০১৮ সালের ক্যাম্প ফায়ারের পর থেকে এটি দেশটির সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানল। ২০১৮ সালে কমপক্ষে ৮৫ জন নিহত হয় এবং প্যারাডাইস শহর ধ্বংস হয়ে যায়।
হাওয়াই ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির মুখপাত্র অ্যাডাম ওয়েইনট্রাব বলেছেন, ‘আমরা এখনও জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় আছি। অনুসন্ধান ও উদ্ধার আমাদের অগ্রাধিকার।’
আরও পড়ুন: চলতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাবদাহে ১৪৭ জনের মৃত্যু
ওয়েইনট্রাব আরও বলেন, ফায়ার লাইনগুলো নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত উদ্ধারকারী দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ভেতরে ঢুকতে পারবে না।
বস্কো বে নামে লাহাইনার এক বাসিন্দা মঙ্গলবার রাতে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করছেন। ভিডিওতে দেখা যায়, রাস্তার প্রায় প্রতিটি ভবনে আগুন জ্বলছে, বাতাসের মধ্যে স্ফুলিঙ্গ ছুটে আসছে।
বে বলেন, তিনি দ্বীপের বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে একজন। তিনি দ্বীপের প্রধান বিমানবন্দরে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন তিনি বাড়ি ফেরার অনুমতির অপেক্ষায় আছেন।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা গুয়াতেমালার ৩১ বছর বয়সী বাবুর্চি মার্লন ভাসকেজ জানান, তিনি যখন ফায়ার অ্যালার্ম শুনতে পান, তখন আর গাড়ি নিয়ে পালানোর সুযোগ ছিল না।
তিনি বলেন, ‘আমি দরজা খুলে দেখি আগুন প্রায় আমার উপরে ছিল।’
বর্তমানে তিনি একটি জিমনেসিয়ামের পরিত্যক্ত একটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দৌড়ে পালিয়েছিলাম। প্রায় সারারাত এবং পরের দিন পর্যন্ত আমরা দৌড়েছি। কারণ আগুন তখনও থামেনি।’
লাহাইনার বাসিন্দা কামুয়েলা কাওয়াকোয়া ও আইউলিয়া ইয়াসো দম্পতি ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে তাদের পালানোর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
তারা জানান, তাদের ৬ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে তারা সুপারমার্কেটে গিয়েছিলেন। সেখানে আগুন দেখে দ্রুত তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরেন তারা। এসময় তাদের চারপাশের ঝোপগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তারা দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করে দৌড়ানো শুরু করেন।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নিহত ৩০, আহত ৬০
বৃহস্পতিবার চেলসি ভিয়েরার নামক এক বাসিন্দা জানান, সে ও তার দাদি লুইস আবিহাই হেল মাওলুতে বাস করতেন। সে আগুন থেকে পালাতে পারলেও তার দাদির কী হয়েছে তা তিনি জানেন না। দাদির বয়স ৯৭ বছর।
তিনি বলেন, মানুষ ওই দ্বীপে বসবাসরত স্বজনদের খুঁজছে এবং হাসপাতালে ফোন করছেন। আমার কাছে ফোন নেই, তাই পরিবারকেও জানাতে পারছি যে আমি নিরাপদে আছি।
তিনি বলেন, ‘তিনি (দাদি) কোথায় গেছেন, কোথায় খোঁজ করব বা কাকে জিজ্ঞাসা করব আমি জানি না।’
৯১১, ল্যান্ডলাইন ও সেলুলার পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ায় দ্বীপে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মাউয়ের কিছু অংশেও বিদ্যুৎ চলে গেছে।
রাজ্য পরিবহন পরিচালক অ্যাড স্নিফেন জানান, দ্বীপে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুধবার মাউইয়ের প্রায় ১১ হাজার অধিবাসীকে এবং বৃহস্পতিবার কমপক্ষে ১৫০০ জনকে নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা রাজধানী হনলুলুর হাওয়াই কনভেনশন সেন্টারে কয়েক হাজার মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তূত করেছে।
লাহাইনার দক্ষিণ-পূর্বের কিহেইতে বুধবার রাতেও গাছ ও বাড়িতে আগুন জ্বলতে থাকায় দ্বীপটির মাটি পর্যন্ত পুড়ে লাল হয়ে গেছে।
এই গ্রীষ্মে বিশ্বজুড়ে চরম আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে এটি সর্বশেষতম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের এনভা্য়রনমেন্টাল জিওগ্রাফি’র একজন সহযোগী অধ্যাপক টমাস স্মিথ বলেছেন, হাওয়াইতে দাবানল অস্বাভাবিক নয়। গত কয়েক সপ্তাহের আবহাওয়া একটি বিধ্বংসী দাবানলের জ্বালানি তৈরি করেছিল এবং হারিকেন ডোরা’র ফলে সৃষ্ট প্রবল বাতাস মিলে এই বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
মেয়র মিচ রথ বলেছেন, হাওয়াইয়ের বিগ আইল্যান্ডও বর্তমানে দাবানলের কবলে পড়ছে। যদিও সেখানে কোনো আহত বা ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
হাওয়াইয়ের রাজ্য প্রতিরক্ষা বিভাগের মেজর জেনারেল কেনেথ হারা বুধবার রাতে বলেছেন, তিনি কর্মকর্তাদের যোগাযোগ পুনরুদ্ধার ও খাবার পানি সরবরাহ করার কথা বলেছেন।
আরও পড়ুন: বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক পুনরুদ্ধারের গতি বাড়িয়েছে বেইজিং
তিনি বলেন, ন্যাশনাল গার্ড হেলিকপ্টার আগুনের উপর ১ লাখ ৫০ হাজার গ্যালন (৫ লাখ ৬৮ হাজার লিটার) পানি দিয়েছে।
কোস্টগার্ড জানিয়েছে, তারা ১৪ জনকে উদ্ধার করেছে যারা আগুনের শিখা ও ধোঁয়া থেকে বাঁচতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল।
মাউই কাউন্টির মেয়র রিচার্ড বিসেন জুনিয়র বুধবার বলেছেন, কর্মকর্তারা এখনও আগুনের কারণ অনুসন্ধান শুরু করেননি।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৃহস্পতিবার উটাহ ভ্রমণ করে মাউই’র ঘটনাকে দেশের জন্য বড় বিপর্যয় বলে ঘোষণা করেছেন।
তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছে, যাদের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে; অবিলম্বে তাদের সাহায্য পৌঁছানোর বিষয়টি ফেডারেল সরকার নিশ্চিত করবে।