বাস্তবসম্মত ও মেধাবৃত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার সহায়ক ও সুস্থ পরিবেশে শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় উচ্চশিক্ষার নিশ্চায়ক হলো অস্ট্রিয়া। তবে শিক্ষার অঙ্কুরে নিহিত থাকে কাঙ্ক্ষিত জীবনধারণের স্বপ্ন। আর এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশটিতে পাড়ি জমান লাখ লাখ শিক্ষার্থী। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো অন্যান্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর চেয়ে তুলনামুলকভাবে সাশ্রয়ী খরচে পড়াশোনার সুযোগ দেয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এই বিশ্বায়নের উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে সেঙ্গেনভুক্ত দেশ অস্ট্রিয়া। ৯৮ শতাংশ সাক্ষরতার হারের এই দেশটি বিগত দশক জুড়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ব মানের শিক্ষা নিশ্চিত করে আসছে। সেই অভাবনীয় সুযোগ লাভের জন্য চলুন- অস্ট্রিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন প্রক্রিয়া ও খরচসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
অস্ট্রিয়া কেন উচ্চশিক্ষার অন্যতম গন্তব্য
জাতীয়ভাবে আর্থ-সামাজিক অবস্থা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্ট্রিয়াকে একটি নিরাপদ অভিবাসনের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাশাপাশি বিশ্ব জুড়ে ব্যবসা ও শিক্ষাভিত্তিক নেটওয়ার্কগুলোতে এর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশটিকে পরিণত করেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যে।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশটি ২৯ দশমিক ৪ গ্লোবাল ক্রাইম ইন্ডেক্স নিয়ে পৃথিবীর শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ৩০তম অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, ১ দশমিক ৩১৩ গ্লোবাল পিস ইন্ডেক্স অধিকারী এই রাষ্ট্রটি বিশ্বের তৃতীয় শান্তিপূর্ণ দেশ।
অস্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব জুড়ে শিক্ষার্থী ও স্কলারদের অভিজাত নেটওয়ার্কগুলোতে বহুল সমাদৃত। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি এবং টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনার কিউএস র্যাঙ্কিং যথাক্রমে ১৩৭ এবং ১৯০। এ ছাড়া ৪১৩ নম্বর অবস্থানে রয়েছে গ্রাজ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এবং ৪৭২তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম জোহানেস কেপলার ইউনিভার্সিটি লিঞ্জ।
আর সেঙ্গেনভুক্ত দেশ হওয়ায় সুযোগ থাকছে একই সঙ্গে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো ভ্রমণ করার। এর মাধ্যমে একাধিক ডিগ্রি নেওয়ার এবং চাকরি কিংবা ব্যবসা ক্ষেত্রে ক্যারিয়ারকে সুবিস্তৃত করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
আরো পড়ুন: হাঙ্গেরিতে উচ্চশিক্ষা: আবেদনের উপায়, পড়াশোনার খরচ, স্কলারশিপ, ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা
অস্ট্রিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য যে যোগ্যতাগুলো থাকা দরকার
প্রধান ভাষা জার্মান হওয়ায় দেশটির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনার পাশাপাশি স্কলারশিপ ও চাকরি প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পায় জার্মান ভাষার ওপর দক্ষতা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধুমাত্র স্থানীয় ছাত্রছাত্রীদের অধ্যয়ন ফ্রি। তবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা জার্মান ভাষায় পারদর্শি, তারা তাদের অধ্যয়ন খরচে অনেকাংশে ছাড় পায়। তবে অস্ট্রিয়া থেকে ডিগ্রি লাভের জন্য জার্মান-ই একমাত্র ভাষা নয়। এর বিকল্প হিসেবে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতাও বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পায় সমান গুরুত্ব।
ব্যাচেলর ডিগ্রির জন্য প্রয়োজন হয় ডিপ্লোমা কিংবা হাই স্কুল সনদ পরীক্ষা। স্নাতকোত্তর যে কোনও কোর্স বা ডিগ্রির জন্য একই বা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে স্নাতক করা থাকতে হয়। অ্যাপ্লাইড সায়েন্স ইউনিভার্সিটিগুলোতে স্নাতক ডিগ্রিতে আবেদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পেশাদার অভিজ্ঞতা।
মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য ন্যূনতম ১৮০ ইসিটিএস (ইউরোপীয়ান ক্রেডিট ট্রান্সফার অ্যান্ড অ্যাক্যুমুলেশন সিস্টেম) ক্রেডিট থাকা আবশ্যিক। এর সঙ্গে কমপক্ষে ৬ সেমিস্টারের প্রাসঙ্গিক স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হয়। পিএইচডি প্রোগ্রামগুলোর জন্য প্রয়োজন হয় প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে গবেষণা বা সমতুল্য অধ্যয়নের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
আরো পড়ুন: ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষা: আবেদন পদ্ধতি, খরচ ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা
অস্ট্রিয়ার জনপ্রিয় কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও চাহিদা সম্পন্ন কোর্স
বিশ্বজুড়ে শিক্ষাকেন্দ্রিক প্রসিদ্ধ নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই বেশি ভিড় হয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের। এরমধ্যে অস্ট্রিয়ার প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো-
- ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়
- টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা
- ইউনিভার্সিটি অব ইনসব্রুক
- ক্লাজেনফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়
- ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি
- গ্রাজ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি
- জোহানেস কেপলার ইউনিভার্সিটি লিঞ্জ
- ইউনিভার্সিটি অব গ্রাজ
- ইউনিভার্সিটি অব ন্যাচারাল রিসোর্স অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড লাইফ সায়েন্সেস, ভিয়েনা (বকু)|
আরো পড়ুন: সুইজারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষায় স্কলারশিপ পাওয়ার উপায়
ব্যবসা ও গবেষণা ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার বিকাশে পর্যাপ্ত সুযোগের সূত্রে যে বিষয়গুলো সর্বাধিক প্রাধান্য পায়, সেগুলো হলো
- শিল্পকলা এবং হিউম্যানিটিস
- ব্যবসা প্রশাসন
- ভাষা
- মনোবিজ্ঞান
- মার্কেটিং
- আন্তর্জাতিক ব্যবসা
- কম্পিউটার বিজ্ঞান
- প্রকৌশল|
আরো পড়ুন: সুইডেনে স্কলারশিপ পাওয়ার কিছু উপায়
অস্ট্রিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবেদনের উপায়
সাধারণত দুটি মৌসুমকে কেন্দ্র করে স্নাতক বা ডিপ্লোমা এবং মাস্টার্স প্রোগ্রামগুলোতে ছাত্রছাত্রী ভর্তি নেওয়া হয়ে থাকে। একটি উইন্টার সেমিস্টার, যেটি শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে এবং আর সামার সেমিস্টার শুরু হয় ফেব্রুয়ারি থেকে। অবশ্য কোর্সভেদে প্রতি মৌসুমেই নিবন্ধনের সময়কাল ভিন্ন হয়ে থাকে। যা হালনাগাদ করা হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে। এই অনলাইন পোর্টালগুলোর মাধ্যমে আবেদনের সামগ্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। এ সময় আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র আপলোডের বিষয় থাকে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র
বিশ্ববিদ্যালয়, প্রোগ্রাম ও কোর্স নির্বিশেষে ভর্তির আবেদনে সাধারণত যে কাগজপত্র প্রস্তুত রাখতে হয়-
- পাসপোর্ট এবং ছবি বা নামের সত্যতা প্রমাণে প্রার্থীর নিজের দেশের সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত যে কোনও পরিচয়পত্রের অনুলিপি
- সর্বশেষ ডিপ্লোমা বা হাই স্কুল সনদ পরীক্ষা বা ব্যাচেলর ডিপ্লোমার সনদ
- অ্যাপ্লাইড সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক ডিগ্রির জন্য প্রাসঙ্গিক পেশাদার অভিজ্ঞতা
- ইংরেজি ভাষার দক্ষতা হিসেবে আইইএলটিএস, পিটিই একাডেমিক বা টিওইএফএল স্কোর কিংবা ক্যামব্রিজ সার্টিফিকেট
- জার্মান ভাষায় পাঠদানকৃত কোর্সের জন্য জার্মান ভাষার দক্ষতা প্রমাণপত্র
- এগুলোর পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আরও কিছু কাগজপত্র চাইতে পারে।
আরো পড়ুন: মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষা: উপায়, খরচ ও সুযোগ-সুবিধা
আবেদন পরবর্তী প্রক্রিয়া
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে ব্যাচেলর স্তরে প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া হয়। যেটি সাধারণত একাডেমিক প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার ৬ মাস আগে হয়ে থাকে। অন্যান্য স্তরগুলোতে অনলাইনে (জুম বা স্কাইপে) মৌখিক পরীক্ষা বা ভর্তি ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হয়।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ স্বহস্তে পূরণকৃত আবেদন ই-মেইলের পাশাপাশি ডাকযোগে প্রেরণের দরকার পড়তে পারে। পরবর্তীতে আবেদনের ফলাফলসহ যাবতীয় নির্দেশনা ই-মেইলের মাধ্যমেই জানানো হবে। ভর্তি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হলে অধ্যয়ন ফি পরিশোধের জন্য বলা হয়। এই ফি পরিশোধের পরেই অফার লেটার এবং স্টুডেন্ট আইডি ইস্যু করা হয়।
অস্ট্রিয়ার স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন পদ্ধতি
দীর্ঘমেয়াদি অধ্যয়নের জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে হবে ডি-টাইপ ভিসায়, যেখানে সেঙ্গেনভুক্ত দেশগুলোতে ৬ মাসের বেশি থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। অস্ট্রিয়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস শুরু হওয়ার কমপক্ষে ৩ থেকে ৬ মাস আগে ভিসার আবেদন করা উচিত।
এখানে প্রধানত পর্যায়ক্রমে প্রথমে রেসিডেন্স পারমিট এবং পরবর্তীতে এন্ট্রি পারমিটের জন্য আবেদন করতে হয়। প্রথম পর্যায়ের আবেদনের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় ভারতের নয়াদিল্লির অস্ট্রিয়ান দূতাবাসে।
অস্ট্রিয়ার দূতাবাসের ঠিকানাঃ ইপি-১৩, চন্দ্রগুপ্ত মার্গ, চাণক্যপুরী, নয়া দিল্লি, দিল্লি-১১০০২১, ভারত।
আরো পড়ুন: যে ১০টি দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অল্প খরচে পড়তে পারবেন
আবেদনের যাবতীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে দূতাবাসে যাওয়ার আগে ই-মেইলের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিতে হবে। অতঃপর ফিরতি ই-মেইলে নির্দিষ্ট তারিখ জানানো হলে সে অনুযায়ী উপস্থিত হতে হবে দূতাবাসে। এ সময় আঙ্গুলের ছাপ ও ফটোগ্রাফের মতো বায়োমেট্রিক ডেটা নেওয়া হবে।
আবেদনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হলে দূতাবাস থেকে সেটি সরাসরি অস্ট্রিয়াতে পাঠানো হবে এবং সেখানে রেসিডেন্স পারমিটের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এখানে যেহেতু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়, তাই প্রার্থীকে অস্ট্রিয়াতে প্রবেশের অন্তত তিন মাস আগে আবেদন করা উচিত।