অবরুদ্ধ হবার পরে শহরের প্রসিদ্ধ স্থানে পানশালা, বিপণি বিতান, প্রসিদ্ধ রাস্তা ও প্লাজাগুলোতে এখন সুনসান নীরবতা। ঐতিহাসিক ও পর্যটকদের পদাচরণায় মুখরিত এসব প্রসিদ্ধ স্থানগুলোর বর্তমান চিত্রের সাথে একসপ্তাহ আগের চিত্রের ফারাক অনেক। দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হয়।
আরও পড়ুন: স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত
মহামারি যে মানুষদের মানবিক ধর্ম ও সহানুভূতিকে হত্যা করে দেয় সেটা মনে হলে ভয় চলে আসে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ মহামারিগুলো আমাদের মানব সভ্যতার বুকে অনেক অনেক ক্ষত রেখে গেছে। তাড়া করা মৃত্যুর ছোবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে মানুষ এ সময় অনেক স্বার্থপর ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। নিজের আপন কেউও যদি মহামারিতে আক্রান্ত হয়, সম্পর্কের নিবিড় বিশ্বস্ততায় ফাটল ধরিয়ে পরম আস্থার মানুষটাও তার চোখে জমদূত হয়ে ওঠে। মহামারিতে মানুষ আপন মানুষকে ছেড়ে চলে গেছে। বাবা-মা তার আক্রান্ত সন্তানকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। আবার সন্তানও মা-বাবাকে ছেড়ে পালিয়েছে। স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক প্রেমিকার ভালবাসা, আবেগ মৃত্যুভয়ের কাছে হার মেনেছে। ভিন্ন উদাহরণও আছে। তবে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা কথাটাই মহামারির ক্ষেত্রে অনেক বেশি সত্য হয়ে দাঁড়ায়। আর ভয়টাও সেখানে।
তবে এখন মানুষ অনেক বেশি মানবিক গুণসম্পন্ন, বিবেক সচেতন। চীনের উহান রাজ্যে করোনাভাইরাসের ছোবলে অকাতরে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর অনেক ডাক্তার, নার্স, স্বেচ্ছাসেবক মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নিজের জীবন বিলিয়েও মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সে একদিনে ৪৯৪ জনের মৃত্যু
প্রাণঘাতী ‘কোভিড-১৯’ মহামারি পৃথিবীকে কতোটা ক্ষতি সাধন করে ক্ষান্ত হয় সেটা হয়তো সময়ই বলে দেবে, তবে ইউরোপের দেশগুলো এই ভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে যে প্রস্তুত সেটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেখানে মানবিকতার জোরও চোখে পড়ার মতো। স্পেনের গণস্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো দিন-রাত তাদের সেবার জন্য জেগে আছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভাইরাসের সংক্রামণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে গণস্বাস্থ্যের সেবাদানের যে কঠিন লড়াই সেখানে হারতে গিয়ে জিতে আছে এখনও স্পেন।
দেশটিতে ভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর থেকে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে মহামারির পরিধি। কোনো কোনো দিন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজারেরও বেশি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গণস্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার, নার্স সবাই অভয়ের কথা বলছে।
টিভিতে ঘোষণা দিচ্ছে, ভয় নয় সাহস নিয়ে আমাদের এই যুদ্ধে জয় করতে হবে। যার যে দায়িত্ব সে তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে হবে। বাসায় থাকতে হবে। বাচ্চাদের কিভাবে বিনোদন দেয়া যেতে পারে বাসায় সেটাও বলে দেয়া হচ্ছে। দেশটির প্রতিটি প্রদেশে হটলাইন চালু করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের ইস্যুর বাইরে স্বাস্থ্য সেবার অন্যান্য কম গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়গুলো আপাতত আলাদা করা হয়েছে। শুধুমাত্র কোনো উপসর্গ হলে হাসপাতালে যেতে হবে সেটা বার বার বলে দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া বার বার জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, না বুঝে সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভিড় করলে যাদের ক্রিটিক্যাল ইস্যু তাদের স্বাস্থ্য সেবার বিঘ্ন ঘটবে। দেশটির স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব নিয়োজিত সরকারি ও প্রাইভেট স্বাস্থ্য সেবা একযোগে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়বে সেই ঘোষণা দিয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ। দুই লক্ষ মিলিয়ন ইউরোর সহযোগিতা ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার জন্যে।
স্পেনে বাংলাদেশিদের বসবাস প্রায় ৪০ বছর ধরে। সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বাস করে দেশটির রাজধানী মাদ্রিদ ও দেশটির অঙ্গরাজ্য কাতালোনিয়ার রাজধানী বাণিজ্যিক শহর বার্সেলোনা শহরে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দুটো শহরেই মহামারি বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। মাদ্রিদে ৮ জন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। বার্সেলোনা শহরেও ভাইরাসের সংক্রমণের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে। এখানেও বাংলাদেশি হাসপাতালে ভর্তি আছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এমন সন্দেহে।
কাতালোনিয়া অঙ্গরাজ্যের প্রেসিডেন্ট কিম তোররাও স্বয়ং করোনাভাইরাসে আক্রান্তের শিকার হয়েছেন। তবে তার সরকার ও মন্ত্রিপরিষদের যথাযথ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আগাম স্কুল-কলেজ বন্ধসহ অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে এখন পর্যন্ত মহামারি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। স্পেনের এই দুটি শহরের অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে বাংলাদেশিরাও গৃহবন্ধী হয়ে পড়েছেন। তারা অজানা আতঙ্কে সন্তানদের আগলে রেখে গৃহবন্দী হয়ে দিনাতিপাত করছেন।
তাদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অনিশ্চিত একটা সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে প্রায় সবাই নিজেদের মতো করে বাসায় খাবার মজুদ করে রেখেছেন। তবে মহামারি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে তারা ভীত সন্ত্রস্ত বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশের পরিবার-পরিজনদের সাথে কথা বলে তারা তাদের উৎকণ্ঠার কথা প্রতিনিয়ত জানাচ্ছেন।
দেশটি অবরুদ্ধ হবার কারণে, কল-কারখানা থেকে শুরু করে ব্যবসা প্র্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অনেক বাংলাদেশির চাকরি চলে গেছে, অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে ছাপিয়ে আগে এই মহামারি থেকে নিজেদের জীবন বাঁচানোটাকেই তারা মুখ্য হিসেবে দেখছেন তারা।
গত ১৬ মে দেশটি অবরুদ্ধ ঘোষণার পর দেশটিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। রাতে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সাথে সীমান্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বড় শহরগুলোতে কারণ ছাড়া পথে নামলে এবং পথে নামার কারণ প্রমাণ করতে না পারলে ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার ইউরো জরিমানা করা হচ্ছে।
মূল শহরের কিছু ফার্মেসি আর জীবন ধারণের প্রাথমিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর যোগানদাতা কিছু সুপার মার্কেট শুধু খোলা রয়েছে। তবে মানুষ চলে দূরত্ব বজায় রেখে। একজন থেকে আরেকজন মানুষ থেকে ১ মিটার দূরত্ব রেখে প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য মার্কেটগুলোতে আসে। অনেকের মুখ মাস্কে ঢাকা, হাতে গ্লাভস পরা। চেহারায় চাপা আতঙ্ক। ইউরোপিয়ানরা মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে মানবিক দূরত্ব কমিয়ে আনলেও করোনাভাইরাসের মহামারিতে এখন রাস্তায় দূরত্ব বজায় রেখে চলে। মনে ভয়, মানুষ মানুষকে সন্দেহ করে। পাশের জন বুঝি মরণঘাতী ভাইরাস বহন করে আনছে। রাস্তার বা কোন স্থানে বিশেষ প্রয়োজনে মানুষ একসাথে হলেও দূরত্ব কমে আসলে অকপটে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় সরে যেতে।
অথচ কিছুদিন আগেই এই মানুষগুলো পথেঘাটে অন্য মানুষদের সহযোগিতার জন্য দৌঁড়ে কাছে চলে আসতো নির্দ্বিধায়। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কখনও কোনো রকম কার্পণ্য দেখিনি তাদের মধ্যে। তবে বড় কথা হচ্ছে, এই যে দূরত্ব রেখে চলা, এটা আসলে আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য, মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের জন্যে। এই দূরত্বটা শরীরের, মনের দূরত্ব নয়।
পৃথিবীর কোন মহামারিই মানব সভ্যতাকে বিলীন করে দিতে পারেনি। হারানোর ক্ষত আর শোক দুঃখ ভুলে মানুষ আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। জীবনকে এগিয়ে নিয়েছে। বর্তমান সময়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে মানুষের সাথে তার সামাজিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাটাও বন্দী হয়ে পড়েছে। তবে মহামারি প্রাদুর্ভাব কমে গেলে মানুষ আবারও মানবিক হয়ে সবার সাথে হাতে হাত মেলাবে, বুকে জড়িয়ে কোলাকুলি করবে। নতুনভাবে জীবন সাজবে। জয় হবে মানুষের ভালোবাসার। জয় হবে মানবতার।
মিরন নাজমুল: স্পেনের বার্সেলোনায় প্রবাসী ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও লেখক