ষড় ঋতুর পরিক্রমায় গরমকাল কোন কোন ক্ষেত্রে ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে দেশের ভেতরেই এমন কিছু মনোমুগ্ধকর জায়গা আছে, যেখানে গরমকালে স্বল্প খরচে ভ্রমণ করা যায়। ভ্রমণের ষোলকলা পূর্ণ করতে রোদ-বৃষ্টির এই সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নির্বাচন করতে হবে সেই জায়গাগুলোকে। যে কোন দর্শনীয় স্থানের ক্ষেত্রেই সেখানকার বৈশিষ্ট্যের সাথে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় তা হচ্ছে আবহাওয়া। নির্দিষ্ট কিছু সময়ে জায়গাগুলো নিজস্ব বিশেষত্ব নিয়ে চোখ জুড়ানো নিসর্গ রূপ ধারণ করে। তাই চলমান উষ্ণতায় চলুন খুঁজে নেয়া যাক বাংলাদেশের দারুণ কিছু ঘোরার জায়গা।
গরমকালে কম খরচে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশের ১০টি দর্শনীয় স্থান
সিলেটের পাংথুমাই
সমগ্র বাংলাদেশের গ্রামগুলোর সৌন্দর্য্যের মধ্যে যদি তুলনা করা হয় তাহলে সবার উপরে থাকবে সিলেটের পাংথুমাই। জাফলং ইউনিয়নের সীমানায় গ্রামটি গাছের সবুজ, মেঘের ধূসর এবং জলপ্রপাতের চঞ্চলতার মেলবন্ধনে যেন এক অপরূপ নিসর্গ। খুব জোরে বাতাস বয়ে গেলে অপার্থিব গোঙানি গ্রামের শেষে গুহার উপস্থিতির জানান দিয়ে যায়।
কম খরচে ভ্রমণের জন্য ঢাকা থেকে সিলেটগামী ট্রেনের ৩২০ টাকার শোভর চেয়ার বুকিং করা যেতে পারে। অতঃপর সিলেট শহর থেকে মাইক্রোবাস রিজার্ভ নিয়ে ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকার মধ্যে পৌছা যাবে পাংথুমাইয়ে। গোয়াইনঘাটের সালুটিকর অথবা জৈন্তাপুরের সারিঘাট উভয় পথেই একই দূরত্ব ও সময়ে খরচ হবে।
পড়ুন: হিমাচল, জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ ভ্রমণ: দর্শনীয় স্থান ও খরচ
ভোলার মনপুরা
শহরের কোলাহল ও দাবদাহ থেকে এক নিমিষেই মুক্তি দিতে পারে মনপুরা। ভোলা জেলার নদী ও সাগরের মিলনস্থলে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরা। এখানকার পিন-পিতম নিরবতায় এক সূর্যাস্ত অথবা তারা ভরা রাতের সামীয়ানা এক জীবন্ত রূপকথার আমেজ দেবে।
এ দ্বীপে যেতে হলে ঢাকার সদরঘাট থেকে যে কোন দিন বিকেল ৫ টায় উঠে পড়তে হবে হাতিয়ার লঞ্চে। সূর্যোদয়ের পর ঠিক সাড়ে ৭ টায় মনপুরা দ্বীপে নামিয়ে দেবে। লঞ্চ ডেকের ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০ টাকা। ফিরতি লঞ্চ ধরতে হলে ঠিক দুপুর ২টায় অপেক্ষা করতে হবে মনপুরার রামনেওয়াজ লঞ্চঘাটে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল
একটি কুঁড়ি দুটি পাতার দেশে মন ভুলানো রুপের আধার শ্রীমঙ্গল। পাতা আর কুঁড়ির এই দেশ পাহাড় আর চা বাগানে ঘেরা আর সব সময়ই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক আদর্শ স্থান। ৪০টি চা বাগানের এই উপজেলা কিছু হাইল-হাওর ছাড়া পুরোটাই চা বাগানে দখলে। মাইলের পর মাইল চা বাগান ছাড়াও এর দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে নির্মাই শিববাড়ী ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
পড়ুন: কলকাতা ভ্রমণ: দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার উপায় ও খরচ
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলগামী ট্রেনের শোভন চেয়ারের ভাড়া পড়বে ৩২০ টাকা।
সিলেটের জাফলং
খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে পিয়াইন নদী ঘেরা জাফলং যেন প্রকৃতির এক স্বপ্নীল খেয়াল। আনমনে কোন শিল্পী যেন তার নিপুণ হাতে এঁকে দিয়েছেন পাহাড়ের খাঁজে খাসিয়া পল্লী, পানির নিচের পাথর, আর পানের বরজ। কাছেই সংগ্রামপুঞ্জির রাস্তা ধরে এগোলে দেখা মিলবে দেশের প্রথম সমতল চা বাগান।
ট্রেনে চড়ে ঢাকা থেকে সিলেট নামার পর শিবগঞ্জ থেকে ৮০ টাকায় জাফলঙের বাস পাওয়া যাবে। শুধু জাফলং দেখার জন্য ভ্রমণসঙ্গী কম হোক বা বেশি হোক; এই ট্রেন ও বাসের যাতায়াত মাধ্যমটিই সাশ্রয় হবে।
পড়ুন: সিঙ্গাপুর ভ্রমণ: সাগরের উপকন্ঠে অভিজাত উদ্যাননগরী
নেত্রকোণার বিরিশিরি
চীনামাটির পাহাড় ঘেরা অপরুপ নীল হ্রদ দেখতে হলে যেতে হবে দুর্গাপুরের এই ঐতিহ্যবাহী গ্রামটিতে। হ্রদের নীল পানির ধারা শুরু হয়েছে সমেশ্বরী নদী থেকে। আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে রানীখং গির্জা, কমলা রানীর দীঘি, পাহাড়ী কালচারাল একাডেমী, হাজংদের কিছু স্মৃতিস্তম্ভ এবং সেন্ট যোসেফের গির্জা।
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় পাওয়া যাবে সুখনগরীর বাস। সুখনগরীতে নেমে উঠে পড়তে হয় নদী পারাপারের নৌকায়। তারপর আবার বাসে ২০ টাকা ভাড়ায় দুর্গাপুর।
সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারীর আশ্রয়স্থল এই জায়গাটির অবস্থান ধলাই নদের উৎসমুখে। সাদা পাথর ছাড়াও এখানে দেখা যাবে রোপওয়ে, উৎমাছড়া, ও তুরুংছড়া।
পড়ুন: ঢাকার কাছেই প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পিং সাইট
ঢাকার কমলাপুর থেকে ট্রেনে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে নেমে সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে চলে যেতে হবে আম্বরখানা মজুমদার পয়েন্টে। সিএনজি ভাড়া নিতে পারে প্রায় ৫০ টাকা। সেখান থেকে বিআরটিসি দোতলা বাস ৬০ টাকা ভাড়ায় সরাসরি ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ট্রলার ঘাটে নামিয়ে দেয়। ঘাট থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় সাদাপাথর জিরো পয়েন্টে যেতে খরচ নিবে মাথাপিছু ১০০ টাকা। জিরো পয়েন্টে পর্যটকদের গোসল করা ও কাপড় বদলানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে।
নারায়নগঞ্জের পানাম নগর
ঢাকার কাছেই এই ঐতিহাসিক জায়গাটি ঢাকার ভ্রমণপিপাসুদের কাছে সেরা দর্শনীয় স্থান। ৪০০ বছরের পুরনো টাকশাল বাড়ি ও নীলকুঠি দেখার সময় মনে হবে সময়টা ঘুরে অতীতে চলে গেছে। এছাড়াও আছে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, গোয়ালদি মসজিদ, পান্থশালা, খাজাঞ্চিখানা, চিত্রশালা, দরবার কক্ষ, ও গুপ্ত পথ।
ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে উঠে নারায়নগঞ্জের পথে নেমে যেতে হবে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা। ভাড়া পড়তে পারে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সেখান থেকে অটোতে ২০ থেকে ৪০ টাকায় পৌছে যাওয়া যাবে পানাম নগরীতে। অতঃপর ১৫ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। জাদুঘরের টিকেটের মূল্য জনপ্রতি ৩০ টাকা। পানাম নগরে ঘুরতে যাবার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, বুধ ও বৃহস্পতিবার জাদুঘরের বন্ধের দিন।
পড়ুন: নেপাল ভ্রমণ: শত বছরের তীর্থস্থান ঘুরতে হিমালয়ের দেশে
কুমিল্লার ময়নামতি
লালমাই পাহাড়, শালবন বিহার, বৌদ্ধ মন্দির, ময়নামতি জাদুঘর একসাথে ঘোরা যাবে কুমিল্লা কোটবাড়ির ময়নামতি গেলে। কুমিল্লার খাদি কাপড় ও রসমালাইয়ের সুখ্যাতি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে আছে।
এক দিনে ঝটিকা সফরের জন্য ঢাকা থেকে সকাল সাতটার মধ্যেই রওনা দিতে হবে। কমলাপুর, যাত্রাবাড়ি ও সায়েদাবাদ থেকে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় পাওয়া যাবে কুমিল্লার বাস। ক্যান্টনমেন্ট অথবা কোটবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে নেমে ২০ টাকা সিএনজি ভাড়ায় পৌছা যাবে শালবন।
শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর সরকারি ছুটির দিন ও রবিবার বন্ধ থাকে, আর সোমবারে বন্ধ থাকে অর্ধ দিবস।
পড়ুন: সীতাকুণ্ড ডে ট্যুর: একদিনে ঘুরে আসুন চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মহামায়া লেক
কুমিল্লার আসল মাতৃভান্ডার থেকে রসমালাই খেতে কুমিল্লা বিশ্বরোড থেকে প্রথমে ২০ টাকা অটো ভাড়ায় যেতে হবে কান্দিরপাড়। তারপর সেখান থেকে রিকশায় মনোহরপুর।
বগুড়ার মহাস্থানগড়
প্রায় ৪ হাজার বছরের এই পুরনো স্থাপনাটি অবস্থান বগুড়ার শিবগঞ্জে। এখানে ঘুরতে যেয়ে চোখে পড়বে বৈরাগীর ভিটা, কালীদহ সাগর, খোদারাপাথার ভিটা, ইস্কান্দারের ধাপ, খুল্লানার ধাপ, মাহী সওয়ার মাজার শরীফ, জগির ভবন, ভীমের জঙ্গল, রোজাকপুর, মহাস্থানগড় জাদুঘর, অররা, জিউৎকুন্ড কুপ, তোতারাম পণ্ডিতের ধাপ, গোবিন্দ ভিটা, তেঘর, ও মাথুরা। শীলাদেবীর ঘাট, বেহুলার বাসর ঘর অথবা লক্ষিন্দরের মেধ, মানকালির দ্বীপ, পরশুরামের প্রাসাদ দেখার সময় মনে হবে প্রাচীন চরিত্রগুলো যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
রাত পৌনে দশটা এবং সোয়া এগারটায় ট্রেনে ৩৯৫ টাকায় চলে যাওয়া যেতে পারে এই প্রাচীন নগরীতে। বগুড়ায় নেমে সিএনজি, টেম্পো বা রিকশা করে যাওয়া যাবে মহাস্থানগড়। এখানে মনে রাখতে হবে শুক্রবার ও রবিবার মহাস্থানগড় বন্ধ থাকে।
পড়ুন: বগালেক, দার্জিলিং পাড়া হয়ে কেওক্রাডং মানেই হারিয়ে যাওয়া রূপকথার রাজ্যে
রাঙামাটির কাপ্তাই লেক
আয়তনে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ এই কৃত্রিম হ্রদ যেন স্বর্গের প্রতিচ্ছবি। এখানে কোন রকম ক্লান্তি ছাড়াই উপভোগ করা যাবে পাহাড়, ঝর্ণা ও অথৈ জলের সাথে সবুজের পরিণয়। দল বেঁধে নৌ বিহারের সময় জলযানটিকে মনে হবে আকাশ ও হ্রদের মাঝে তুচ্ছ এক প্রাণ। এছাড়া আছে রাঙ্গামাটির প্রতীক ঝুলন্ত ব্রিজ, আর শুভলং ঝর্ণা।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ট্রেনের শোভন চেয়ারে খরচ পড়বে ৩৪৫ টাকা। অতঃপর চট্টগ্রামের বদ্দারহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে উঠে পড়তে হবে কাপ্তাইগামী বাসে। এখানে জনপ্রতি ভাড়া নিবে ৮০ থেকে ১২০ টাকা।
শেষাংশ
এই দর্শনীয় স্থানগুলো গরমকালে কম খরচে ভ্রমণের স্বাদ পরিপূর্ণ ভাবে পূরণ করতে পারে। এগুলোর প্রতিটি নিজস্ব আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে উষ্ণ আবহাওয়ায় আবির্ভূত হয় পর্যটকদের সামনে। এই সৌন্দর্য্যের স্বাদ অন্য সময় গেলে মন ভরে আস্বাদন না করেই ফিরে আসতে হতে পারে। আর ভ্রমণকে নির্ঝঞ্ঝাট করতে প্রয়োজনীয় সতর্কতা সহ পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। গরমের জন্য উপযুক্ত পরিধেয় এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দরকারি সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখতে হবে। এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে কোন ঝামেলা পোহানো ছাড়াই সারা বছরই ভ্রমণ করা যাবে।
পড়ুন: বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট করার নিয়ম: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও খরচ