কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি বিভাগে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির দরুণ স্থায়ী চাকরির পাশাপাশি খণ্ডকালীন বা চুক্তি ভিত্তিক কাজের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের তাগিদও বেড়ে চলেছে। শুধুমাত্র একটি চাকরি দিয়ে জীবনযাত্রার নিত্য প্রয়োজনীয় মৌলিক পণ্য বা সেবার মূল্যের উর্ধ্বগতির চাপ সামলানো প্রতিদিনি কঠিনতর হচ্ছে। এমতাবস্থায় অনলাইনে আয়ের উপায়গুলো যেন আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছে। এতে শুধু সংসারের বাড়তি খরচে যে সহায়তা হচ্ছে তা নয়, যাবতীয় খরচ মিটিয়ে সঞ্চয়ের জন্যও ব্যবস্থা হচ্ছে। এমনকি স্থায়ী চাকরিটির বদলে অনলাইন কাজটিকে গ্রহণ করা যাচ্ছে স্থায়ীভাবে। চলুন, জেনে নেয়া যাক- অনলাইনে কাজ করে বাড়তি আয়ের উপায়গুলো সম্পর্কে।
চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে অর্থ উপার্জনের ১০টি উপায়
একটি ইউটিউব চ্যানেল খোলা
এক সময় সাইড জব হিসেবে সেরা উপায় হলেও ইউটিউবিং এখন ক্যারিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ার দরুণ এখন দিনের প্রায় পুরোটা সময় দিতে হয় একটি ইউটিউব চ্যানেলের পেছনে। তবে ভ্লগ শুরুর মাধ্যমে দিনের একটি ছোট অংশ অতিবাহিত করে এখনো ইউটিউবে সফল হওয়া যায়। ভ্লগ ভিডিওগুলো মুলত কন্টেন্ট নির্মাতার নিত্যদিনের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে জড়িত থাকে। তাই শুধুমাত্র একটি স্মার্টফোন থাকলেই নিজের কর্মকান্ডগুলো রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করে দেয়া যায়।
পোস্ট প্রোডাকশন এবং ভিডিও ইডিটের কাজ কম থাকায় এধরণের ভিডিওগুলো কম সময়ে বেশি পরিমাণে বানানো যায়। তাই টার্গেট কীওয়ার্ডগুলোও তুলনামুলক কম সময়ের মধ্যে ভিডিওগুলোকে দর্শকদের নিকট জনপ্রিয় করে তুলতে পারে। গুগল অ্যাডসের রেভেনিউ শেয়ারিং পদ্ধতি ছাড়াও এরকম ভ্লগাররা এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রচারের মাধ্যমেও বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে থাকে।
আরও পড়ুন: যে ১০টি সফটওয়্যার জানা থাকলে চাকরি পেতে সুবিধা হবে
অনলাইন রিসেলিং
খুব সহজ করে বলতে গেলে অপেক্ষাকৃত কম দামে কোন কিছু কিনে তা বেশি দামে বিক্রি করাটাই রিসেলিং। এটা কোন নতুন বিষয় নয়, বরঞ্চ নেট দুনিয়ায় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে ব্যবসায়ের এই পুরনো উপায়টি অনেক সহজ হয়ে গেছে। এখানে শুরুতেই মার্কেট রিসার্চ করে দুটো বিষয়ে সম্যক ধারণা নিতে হবে।
প্রথমটি হলো কোথায় কম দামি জিনিসপত্র পাওয়া যায় এবং দ্বিতীয়টি হলো অনলাইন মার্কেটে সেই জিনিসগুলোর সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য কেমন। ইবে, অ্যামাজন, ইটসি, র্যাকুটেন হলো বর্তমানে রিসেলিং-এর জন্য জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস।
অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং
বেশ পুরনো এই ব্যবসায়িক পদ্ধতিটির জন্য অর্থ ও কৌশলের সঠিকভাবে প্রয়োগ করা দরকার। ডিজিটাল ব্যবসার জগতে এই লিঙ্ক শেয়ারিং ভিত্তিক ধারণাটি ব্যবসার চিরাচরিত সূত্র মেনে চলে। স্বল্প মূল্যের পণ্যের উপর লাভ পেতে হলে বেশি গ্রাহক পেতে হবে। আর বেশি দামের পণ্যের জন্য সীমিত কিছু গ্রাহক হলেই চলবে।
আরও পড়ুন: ইনস্টাগ্রাম থেকে আয় করবেন যেভাবে
এখানে মার্কেটাররা পণ্য তৈরিকারকদের নিকট থেকে পণ্যের লিঙ্ক নিয়ে পুরো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। লিঙ্কে ক্লিক করে পণ্যটি কেনার সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে মার্কেটাররা লিঙ্কটির ডিজিটাল মার্কেটিং-এর উপর অর্থ বিনিয়োগ করেন। অতঃপর চূড়ান্ত ভাবে পণ্য বিক্রি হলে তারা পূর্ব নির্ধারিত স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম অনুযায়ী তার একটা নির্দিষ্ট শতাংশ লাভ করেন। এই শতাংশ লাভের চুক্তিটি এককালীন অথবা প্রতি মাসে পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
উভয় ক্ষেত্রেই পণ্যের লিঙ্ক শেয়ারের সিস্টেমটি একবার চালু করে দিলেই পরবর্তীতে আর কাজ করার প্রয়োজন হয় না। গভীর রাতে মার্কেটার যখন ঘুমিয়ে তখন পৃথিবীর কোন না কেনা প্রান্তে কেউ একজন পণ্যটির লিঙ্কে ক্লিক করে তা কিনে ফেলে।
অনলাইনে ফটো বিক্রি
ইন্টারনেট ফটোগ্রাফারদের ছবি শেয়ারের জন্য পুরো জগৎটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। এর জন্য যে শুধু ডিএসএলআর ক্যামেরা থাকতে হবে তা নয়। মোবাইল ফটোগ্রাফিকেও এখানে আলাদা ভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। ছবি তুলে মার্কেটপ্লেসগুলোতে আপলোড করার পর শুরু হয় তার প্রচারণার কাজ। এখানে ডিজিটাল মার্কেটিং বেশ কার্যকরি ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন: আপনার স্মার্টফোন দিয়ে আয় করার সেরা কিছু উপায়!
অবশ্য এক যুগ আগে মার্কেটিং-এর প্রয়োজন হতো না। ওয়েবসাইটে আপলোড করার পরেই ক্রেতারা ছবি কেনার জন্য ভিড় জমাতো। এখনো জমায় বৈকি; কিন্তু ফটোগ্রাফারদের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় নতুনদের জন্য মার্কেটিং অবধারিত হয়ে পড়ে। অ্যাডোবি, শাটারস্টক, বিগস্টকফটোর মত সাইটগুলো ছবি বিক্রির জন্য প্রথম সারির মার্কেটপ্লেস।
চাকরির দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ফ্রিল্যান্সিং
চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে কাজ করে বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে চাকরির দক্ষতাটিই হতে পারে মুল হাতিয়ার। এক্ষেত্রে কম্পিউটার বিজ্ঞান, সফ্টওয়্যার প্রযুক্তি এবং আইটি(ইনফরমেশন টেকনোলজি) সেক্টরের কর্মচারিরা সবার থেকে এগিয়ে থাকেন। কেননা এই সেক্টরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজগুলোই অনলাইনে বেশ চওড়া দাম উঠে। ছোট একটা মোবাইল অ্যাপ বানিয়েই বেশ ভালো পরিমাণ আয় করতে পারেন সফ্টওয়্যার ডেভেলপাররা।
অ-প্রযুক্তিগত বিভাগেও স্পেশালিস্টরা পিছিয়ে থাকেন না। হিসাব রক্ষক, আইন বিষয়ক কন্সালটেন্ট, অনুবাদক, ভয়েস-ওভার-আর্টিস্ট, কন্টেন্ট রাইটাররা তাদের দক্ষতার ভিত্তিতে উপার্জন করে থাকেন। ফ্রিল্যান্সিং কাজের জন্য আপওয়ার্ক, ফাইভার, ফ্রিল্যান্সার ডট কম, এমনকি ফেসবুকের মত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আনাগোনা হয় ফ্রিল্যান্সারদের।
আরও পড়ুন: চাকরির সিভি ও পোর্টফোলিও তৈরির প্রয়োজনীয় কিছু ওয়েবসাইট
পডকাস্ট শুরু করা
বিস্ময়কর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অডিওবুক প্রকাশ করা পডকাস্ট সাইটগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একটি পডকাস্টের জন্য প্রয়োজন হয় ভালো কন্ঠ, মাইক্রোফোন এবং কম্পিউটার। কি বলা হচ্ছে তা কতটুকু সাড়া ফেলবে তা নির্ভর করছে অডিও কন্টেন্ট এবং কথকের কন্ঠের মাধুর্যতার উপর।
পডকাস্টগুলো অর্থ উপার্জন করে বিজ্ঞাপন থেকে, তাই শ্রোতা সংখ্যা যত বাড়বে অর্থ উপার্জনও তত বেশি হবে। আর ঠিক এই জায়গাতেই আসে ডিজিটাল মার্কেটিং-এর চাহিদা। বিখ্যাত পডকাস্টাররা সব সময় অ্যাপলের আইটিউনকে নির্বাচন করে থাকে। এছাড়াও শীর্ষস্থানীয় পডকাস্ট প্রকাশনার মধ্যে আছে বাযস্প্রাউট, ক্যাপটিভেট, এবং ট্রানজিস্টর-এর মত সাইটগুলো।
সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার
যেহেতু গোটা বিশ্বই বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া জ্বরে আক্রান্ত, তাই এই রোগীদের দিকেই সব সময় দৃষ্টি থাকে সব ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর। ব্যবহারকারিদের সব সময় নিজেদের কন্টেন্টের প্রতি আকৃষ্ট রাখতে বিপুল বিনিয়োগ করে থাকে অনলাইন ব্যবসাগুলো। আর এই আকৃষ্ট রাখার কাজগুলোর ব্যবস্থা করেন সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজাররা।
আরও পড়ুন: অনলাইনে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে প্রয়োজনীয় পাঁচ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম
সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল থেকে শুরু করে পেজ, গ্রুপ, পোস্ট পরিচালনার পাশাপশি গ্রাহকদের সাথে রিয়েল টাইম চ্যাটে অংশ নেয়ার কাজগুলো করে থাকে এই ম্যানেজাররা। ফ্রিল্যান্সিং কাজগুলো মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজ এটি। শীর্ষস্থানীয় মার্কেটপ্লেসগুলো ছাড়াও এই কাজগুলোর দেখা মেলে ইন্ডিড, লিঙ্ক্ডইন, মডস্কোয়াড, এমনকি স্বয়ং ফেসবুকেও।
ডিজিটাল পণ্য বিক্রি
যে কোন ভিডিও, অডিও, গেম, অ্যাপ্স, ওয়েব টেমপ্লেট, প্লাগ-ইন্স এবং যে কোন বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ ডিজিটাল পণ্যের অন্তর্ভূক্ত। প্রায় সময় তৈরিকারকরা তাদের বানানো ডিজিটাল পণ্যটি প্রচারের জন্য মার্কেটারদের সরণাপন্ন হন। প্রতি বিক্রিতে স্বল্প শতাংশ প্রদানের ভিত্তিতে পণ্য নির্মাতা ও মার্কেটারদের মধ্যে ব্যবসায়িক চুক্তি হয়।
অর্থাৎ অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং-এর মাধ্যমে এই বিক্রির কাজ হয়ে থাকে। আর যারা কিনে থাকেন তারা ব্যবহার করেন পণ্য রিসেলিং পদ্ধতি। এ ধরণের পণ্যের জন্য শীর্ষস্থানীয় মার্কেটপ্লেসগুলোর মধ্যে আছে ইটসি, শপিফাই, ইনভাটোর মত সাইটগুলো।
আরও পড়ুন: চাকরি প্রার্থীদের সফল সিভি তৈরির কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ পরীক্ষা করুন
বিভিন্ন অনলাইন ব্যবসাগুলো তাদের অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট উন্নত করতে তাদের টার্গেটকৃত অডিয়েন্সের প্রতিক্রিয়া যাচাই করে থাকে। এই প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যাপারটি সাইট বা অ্যাপটি পরীক্ষা করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এই কাজের জন্য টেস্টারের একটি কম্পিউটার, একটি ওয়েবক্যাম, একটি মাইক্রোফোন এবং একটি ভাল ইন্টারনেট সংযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্ল্যাটফর্ম-প্রদত্ত সফ্টওয়্যারগুলো ব্যবহার করে স্ক্রিন রেকর্ড দেখাতে হয়। ওয়েবসাইট বা অ্যাপটি চালানোটা সহজ কিনা তা পরীক্ষার ফলাফল হিসেবে পরিবেশন করতে হয়। ইউজার-টেস্টিং, ইউজারফিল, ইউজারলিটিক্স প্রভৃতি সাইটগুলো এ ধরনের কাজ সরবরাহ করে থাকে।
ওয়েবসাইট তৈরি করা
মুল ধারণাটি হলো ওয়েবসাইট তৈরি করে গুগল সার্চ ইঞ্জিনে র্যাঙ্ক করে গুগল অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে আয় করা। কিন্তু এখানে সুক্ষ্ম দুটি পার্থক্য আছে। প্রথমটি হলো এই ওয়েবসাইট এক পেজের হয়। আর দ্বিতীয়টি হলো অন্যান্য ওয়েবসাইটের মত এখানে হাজার হাজার কন্টেন্টের প্রয়োজন হয় না। শুধু দরকার হয় নির্দিষ্ট কিছু অডিয়েন্সকে একটি সুনির্দিষ্ট সেবা প্রদান। যেমন গুগলে সার্চ করলে এমন অনেক এক পেজের সাইট পাওয়া যাবে যেগুলোর কোনটা শুধু বড় ছবিকে ছোট করছে, অথবা কোন ওয়েব পেজের লিঙ্ককে ছোট করছে।
আরও পড়ুন: কর্ম জীবনে উন্নতির জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই কিভাবে প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক তৈরি করবেন
এধরনের ওয়েবসাইটগুলোতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ভিউ পাওয়া যায়। এগুলোর কীওয়ার্ড সীমিত কিন্তু সুনির্দিষ্ট থাকে বিধায় গুগল অ্যাডসেন্স থেকে বেশ ভালো পরিমাণ আয় করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন একজন ওয়েব ডেভেলপার এবং একজন ডিজিটাল মার্কেটার। নিয়মিত আয়ের একটি ধারা তৈরি করতে এটি একটি সেরা বিনিয়োগ হতে পারে।
পরিশিষ্ট
চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে কাজ করে বাড়তি আয়ের এই উপায়গুলো মানুষের জীবনে অভাবনীয়ভাবে স্বচ্ছলতা এনে দিচ্ছে। তবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে ভিড় বাড়ার সাথে সাথে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা পূর্বাপেক্ষা জটিলতর হয়ে উঠছে। এছাড়াও প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রসর হওয়ার কারণে আগের চেয়ে অধিক হারে অনেক কাজের চাহিদা কমে যাচ্ছে। তবে ভালো দিক হলো- অনেক নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোতে প্রয়োজন পড়ছে যথেষ্ট ব্যবহারিক দক্ষতার। মুলত অনলাইন টুল্সগুলো জীবনকে সহজ করলেও অফলাইনের মত এ জায়গাগুলোতেও সফলতা কিন্তু রাতারাতি সম্ভব নয়। অর্থের পরিমাণ কম লাগলেও অনলাইনে আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য যথেষ্ট মেধা, শ্রম এবং সময় বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন: কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য কিভাবে নিজেকে গ্রুমিং করবেন?