ভাসমান মসজিদ! বিশ্বজুড়ে এরকম স্থাপনার ধারণাটা নতুন নয়। সর্বপ্রথম এরকম মসজিদের কথা শোনা যায় সৌদি আরবে ১৯৮৫ সালে। ভাসমান মসজিদ-এর স্বর্গ হলো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়শিয়া। এবার বাংলাদেশেও নির্মিত হলো ভাসমান মসজিদ। মুসলিম বিশ্বে ভাসমান মসজিদ সভ্যতার নতুনত্ব ও আভিজাত্যের রূপরেখা বহন করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পটভূমিটা একটু ভিন্ন। গত ৫ অক্টোবর মঙ্গলবার সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার অন্তর্গত প্রতাপনগর ইউনিয়নে উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশের প্রথম ভাসমান মসজিদ মসজিদে নূহ (আ.)। 

আজকের ফিচারটিতে মূলত এই মসজিদটির উপরই আলোকপাত করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা’র ভাসমান মসজিদ-এর পটভূমি

পরপর দু’বছর আম্ফান ও ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের প্রতাপের শিকার প্রতাপনগর এলাকাটি এখনো কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর জোয়ার-ভাটা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আজও সমগ্র এলাকাটি পানিতে নিমজ্জিত থাকায় এলাকাবাসীদের অধিকাংশ নিত্য নৈমিত্তিক কর্মকাণ্ড নৌকাতে সারতে হয়।

সেই ইয়াস ও আম্ফানের তাণ্ডবে বন্যতলা এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে খোলপেটুয়া নদীভাঙনে হাওলাদার বাড়ি এলাকায় অবস্থিত বাইতুন নাজাদ জামে মসজিদটি মূল স্থলভাগ থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। এতে করে স্থানীয় মুসল্লিরা মসজিদে যেয়ে নামায আদায়ে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যান।

পড়ুন: বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট করার নিয়ম: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও খরচ

এরই মাঝে মসজিদের ইমাম হাফেজ মঈনুর রহমান প্রতিদিন সাঁতরে যেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযান দিতেন ও নামায পড়তেন। মাঝে মধ্যে নৌকা পেলে পানিপথটুকু পার হতে সুবিধা হতো। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তাকে সাঁতরে যেতে হতো এবং কখনো কখনো চার ওয়াক্ত নামায তাকে একাই পড়তে হতো।

জোয়ারে ভিটে বাড়ি সব হারিয়ে বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে ইমাম মঈনুর রহমান এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এর মধ্যেও বিধ্বস্ত প্রায় মসজিদটির কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করে গেছেন। মাঝে মধ্যে মসজিদে পানি উঠে গেলে মসজিদের ছাদেই রাত কাটাতেন তিনি।

২০২১ এর সেপ্টেম্বর সেই পানিবন্দি মসজিদ থেকে ইমাম সাহেবের সাঁতরে আসার দৃশ্যটি ভিডিও করেন সাতক্ষীরা কলেজের প্রভাষক ইদ্রিস আলী ও তাঁর ছাত্র একটি মানবকল্যাণ ফাউন্ডেশন ডু-সামথিং-এর স্বেচ্ছাসেবক সাইদুল। ভিডিওটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে ডু-সামথিং-এর পক্ষ থেকে ইমামের জন্য নগদ পাঁচ হাজার টাকাসহ মসজিদে যাওয়ার জন্য একটি নৌকা দেয়া হয়।

আরও পড়ুন: ২০০ কেজি সোনায় কারুকার্যমণ্ডিত হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পবিত্র কোরআন

ভাসমান মসজিদ তৈরিতে যারা অবদান রেখেছেন

ভিডিও দেখার পর প্রতাপনগরের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে ভাসমান মসজিদ-এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন চট্টগ্রামের মানবসেবামূলক সংগঠন আলহাজ্ব শামসুল হক ফাউন্ডেশন-এর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নাসিরউদ্দীন। নৌকার উপর নির্মিত এই বিশেষ ধরনের মসজিদটির নকশা এঁকেছেন ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়া-এর কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর এসএমএ মোতাকাব্বের।

উদ্বোধনের সময় যোহর নামায আদায় করে ইমাম মঈনুর রহমান স্থানীয় মুসল্লীদের সাথে নিয়ে এই মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি মানুষের জন্য দোয়া করেন।

পড়ুন: নাজমুন নাহার: পৃথিবীর ১৫০তম দেশ ভ্রমণ করে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বাংলাদেশি পরিব্রাজক

ভাসমান মসজিদ-এর আদ্যোপান্ত

প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত মসজিদটির নির্মাণে সময় লেগেছে মোট ১২ দিন। পানিতে প্রায় নিমজ্জিত সেই বাইতুন নাজাদ জামে মসজিদ-এর পাশেই স্থাপন করা হয়েছে ভাসমান মসজিদটি। যে কোন সময় পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে বাইতুন নাজাদ মসজিদটি। তাই আযান দেয়া ও নামায পড়ানোর কাজ সব নতুন ভাসমান মসজিদেই করা হবে।

৮০০ বর্গফুটের এই মসজিদে ৮ কাতারে ৫৫ থেকে ৬০ জন মুসল্লির এক সাথে নামায আদায়ের জায়গা আছে। পানির ট্যাংক ও একটি টয়লেটসহ একসঙ্গে চারজনের ওজু করার মত ব্যবস্থা আছে। নামায পড়ার জায়গায় আছে একটি মাইক সেট এবং তেলাওয়াতের জন্য চারসেট কোরআন শরীফ। মসজিদকে ভাসমান নৌকার ওপর স্থির রাখার জন্য নৌকার দুই পাশে ৪টি করে মোট ৮টি ২৫০ লিটারের ড্রাম বাঁধানো আছে।

পড়ুন: তোগুড়: তরমুজের রস দিয়ে বানানো নতুন গুড়

পরিশিষ্ট

এই ভাসমান মসজিদ ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারণ করা হবে। এই এলাকার পানি সরে গেলে মসজিদটিকে পার্শ্ববর্তী কোন বন্যার্ত এলাকায় পানিবন্দি কোন মসজিদের সাথে যুক্ত করা হবে। নদী বিধৌত সমগ্র প্রতাপনগর প্লাবনমুক্ত হলে মসজিদের নৌকাটি আত্মনির্ভরশীল প্রকল্পের আওতায় জীবিকা নির্বাহের জন্য অসহায় কোন পরিবারকে দেয়া হবে। মসজিদের ঘরটি ব্যবহৃত হতে পারে চিকিৎসা অথবা শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে।