বাঙালি শব্দটির সাথে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর তা যদি হয় বুফে, তাহলে তো কথাই নেই! পশ্চিমা খাবার প্রথা থেকে শুরু হলেও বুফে এখন বাংলাদেশিদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানী জুড়ে পুরনো নামকরা রেস্টুরেন্টগুলোর পাশাপাশি নতুন অনেক ক্যাফে চালু হচ্ছে এই বুফেকে কেন্দ্র করে। শুধু তাই নয়, নানা উপলক্ষ ছাড়াও কম খরচে বুফে খাওয়ার সুবিধা দিচ্ছে রসনা নির্ভর ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন বাজেটের মধ্যে ঢাকার সেরা বুফে রেস্টুরেন্টগুলোতে সময় কাটানো মানেই আনলিমিটেড পেটপূর্তি। চলুন, সেই রেস্টুরেন্টগুলোর সেরা বুফে ডিল নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
ঢাকার সেরা ১০টি বাজেট বুফে রেস্টুরেন্ট
বুফে স্টোরিস (ধানমন্ডি, মিরপুর, গুলশান)
খাবারের স্বর্গ ধানমন্ডির বাজেট বুফের মধ্যে এই রেস্টুরেন্টটি অন্যতম। ধানমন্ডি-২ নাম্বার রোড এবং মিরপুর-১১ এর দুই শাখাতেই বেশ সাশ্রয়ী এবং পুষিয়ে নেয়ার মত মূল্যের বুফে পরিবেশন করা হয়। এদের ৬০০ টাকার ৬৫টি আইটেমের প্যাকেজটিতে আলাদা করে ভ্যাটসহ অন্যান্য খরচের কথা ভাবতে হবে না। আর খাবারের কোয়ালিটিতে যে কোন ভোজন রসিক অনুভব করবেন, যে তিনি সঠিক মূল্যের খাবারটিই নির্বাচন করেছেন। সবচেয়ে চমৎকার বিষয়টি হল যে, তারা রেগুলার পানির পাশাপাশি পছন্দনীয় একটি কোমল পানীয় দেয়। দেশি থেকে চাইনিজ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের খাবারের পাশাপাশি থাকে মিষ্টান্ন আইটেমের দারুণ সমারোহ।
গরুর মাংসের রেজালা এবং লাইভ কাবাব স্টেশন থেকে খাবার মেনুর দুটি প্রধান আকর্ষণ। যে কোন স্পট রিজার্ভ করার জন্য আগে থেকে কল করে যাওয়া উত্তম। কারণ যে কোন দিনেই রেস্তোরাঁটি খুব দ্রুত লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। সমস্যা হিসেবে শুধু এই ভিড়টাকেই বিবেচনা করা যেতে পারে। এছাড়া জায়গা বা খাবার নিয়ে কোনও উল্লেখযোগ্য অসুবিধা নেই। যেকোন ব্যক্তিগত বা কর্পোরেট ইভেন্টের জন্য ভেন্যু বুক করার জন্য উপযুক্ত একটি জায়গা বুফে স্টোরিস।
পড়ুন: গ্রীন কফি: উপকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও বানানোর নিয়ম
প্রিমিয়াম লাউঞ্জ, মিরপুর
প্রিয়জনদের সাথে একটি সুন্দর বুফে লাঞ্চ বা ডিনারের জন্য যে কেউ মিরপুরে অবস্থিত এই রেস্টুরেন্টটিতে দারুণ একটি স্পট লুফে নিতে চাইবে। লাঞ্চের জন্য ৬৫-এর বেশি আইটেম এবং রাতের খাবারের জন্য ৭৫-এর বেশি আইটেম সহ বুফের সাশ্রয়ী দামগুলো দেখে আশ্চর্য হতে হয়। খাবারের কোয়ালিটি নিয়ে যেখানে কোন আপোস করা হয়নি, এরপরও আরামদায়ক ইন্টেরিয়র; সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে চাহিদা থেকেও বেশি কিছু। লাঞ্চের বুফের জন্য ৫৯০ টাকা এবং ডিনার বুফের জন্য ৬৯০ টাকা; আর যাবতীয় চার্জ এর ভেতরেই।
প্যাকেজে মিলবে ভাজা ভাত, বিরিয়ানি, নান, মুরগি, গরুর মাংস সহ আরো কিছু। তবে তাদের মিষ্টান্নের ভান্ডারটি নজর কাড়ার মত। রেড ভেলভেট কেক, ট্রাইফেল পুডিং, চকোলেট ইক্লেয়ার-এর স্বাদ একবার নেয়ার পর আবার সেখানে ফিরে যেতে মন চাইবে।
রেডরেস, শ্যামলী
শ্যামলীর রিং রোডের এই রেস্টুরেন্টটি যে কোন ছুটির দিনে বন্ধু-বান্ধব বা পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর মত দারুণ জায়গা হতে পারে। এছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আশেপাশের অঞ্চলগুলো থেকে যে কেউ অনায়াসেই এখানে নিজের জায়গাটি বেছে নেন। ছুটি বা সপ্তাহান্তের কথা বিশেষ ভাবে বলার কারণ হচ্ছে শুধুমাত্র এই সময়গুলোতেই এখানে ৫০০ টাকায় বুফে পরিবেশন করা হয়।
পড়ুন: লাল চাল: কেন খাবেন এবং কারা এড়িয়ে চলবেন?
এই রেস্তোরাঁয় তাদের মেনুতে আনলিমিটেড চাইনিজ খাবার রয়েছে। আইটেমের মধ্যে আছে স্প্রিং রোলস, বিশেষ ফিরনি, মিষ্টি, টক চিকেন, গ্রিলড চিকেন, এবং ভাত। গরম খাবারগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ঘন থাই স্যুপ দুর্দান্ত। অন্যান্য স্ন্যাক্স আইটেমের মধ্যে আনলিমিটেড পিৎজার কোন তুলনা হয় না। প্রচন্ড ভিড় সামলাতে না চাইলে আগে থেকেই কল দিয়ে পছন্দ মত জায়গা রিজার্ভ করে নিতে হবে।
ওয়াটার গার্ডেন রেস্টুরেন্ট, বনশ্রী
দক্ষিণ বনশ্রীর বাগানবাড়িতে এই পার্টি সেন্টারটি প্রবেশমুখেই দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায় নয়নাভিরাম কৃত্রিম ঝর্ণার দৃশ্য দেখিয়ে। একদম মুল অংশে দেয়ালে ফ্রেমে বাধা পেইন্টিংগুলো পুরো ইন্টেরিয়রে দিয়েছে নিপুন শৈল্পিকতার ছোয়া। সিড়ি বেয়ে রুফটপে উঠে গেলে একটু ভীড়মি খেতে হবে। মনে হবে অত্যাধুনিক শহর ছেড়ে যেন সবুজ অকৃত্রিম এক জগতে প্রবেশ করা হলো। ছোট ছোট টবের গাছের পাশে বাঁশে গড়া প্রতিটি বসার জায়গা।
খাবারের বিষয়ে বলতে গেলে ৬০-এর বেশি আইটেম নিয়ে এদের বুফে বেশ মান সম্মত। ৬৯৯ টাকার মধ্যে বিশাল প্যাকেজে আছে ফ্রাইড রাইস, চিকেন চিলি অনিয়ন, চাইনিজ সবজি, রোস্টেড তন্দুরি চিকেন, সেদ্ধ মাশরুম, ভাজা সবজি, ডিপ ফ্রাই পেঁয়াজ, ফ্রাইড চিকেন, গরুর মাংস সিজলিং, বিভিন্ন ধরনের কারি এবং মিক্সড সালাদ।
পড়ুন: জবা ফুলের চা: গুণাগুণ, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও বানানোর পদ্ধতি
বাফেট প্যালেস, মিরপুর, মোহাম্মদপুর
প্লাস্টিকের হলেও ফুল-পাতা ও অপূর্ব আলোকসজ্জার মাঝে বসে খেতে কার না ভালো লাগে। বুফের এই প্রাসাদটি সেই ভালো লাগার পুরোটাই পুরন করবে থাই, চাইনীজ, ভারতীয় ও বাঙালী খাবারের পরিমিত মেলবন্ধন দিয়ে। এদের আনলিমিটেড মাটন কাচ্চি সহ ৭৫-এর অধিক আইটেমের বুফের মূল্য ৬৫০/= টাকা। তবে শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর শাখায় ৫৯৯ টাকায় পরিবেশ করা হচ্ছে বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারে। ৩ থেকে ৬ বছরের বাচ্চাদের জন্য অর্ধেক মূল্য।
সাধারণ বুফের আইটেম তো আছেই, তবে এদের বিশেষত্ব হচ্ছে মাটন কাচ্চি, চিকেন দম বিরিয়ানি, রুটি রশমালাই ও দোই ফুসকা। আনলিমিটেড কোমল পানীয়র সাথে থাই ও চাইনিজ আইটেমগুলোও এদের অতিথিদের ভালো লাগাটা ধরে রেখেছে।
জেড কিচেন, বসুন্ধরা
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা নতুন এই রেস্তোরাঁটি ইতোমধ্যেই স্থানীয়দের কাছে প্রিয় খাবারের জায়গায় পরিণত হয়েছে। বসুন্ধরার মত অভিজাত এলাকাতে এই কিচেনে ৬০-এর বেশি আইটেমের লাঞ্চ বুফের দাম ৬০০ টাকা। রাতে ৭০-এর বেশি আইটেমের জন্য বুফের দাম পড়বে ৭০০ টাকা। সাথে কোমল পানীয় যত খুশি তত নেয়া যাবে। ৭ বছরের ছোট বাচ্চাদের জন্য এখানে ৫০ শতাংশ এবং স্টুডেন্ট আইডি কার্ডধারীদের জন্য ১০ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ছিমছাম এই রেস্টুরেন্টটি ১০০-এর বেশি অতিথিদের বসার জায়গা দিতে সক্ষম।
পড়ুন: কঠোর ডায়েটের স্বাস্থ্য ঝুঁকিসমূহ জেনে নিন
সালাদ লাভার্স, বসুন্ধরা সিটি শপিং মল
জনপ্রিয় শপিং মল বসুন্ধরায় অবস্থিত এই ফুড কোর্টটি খাবার পরিবেশন করে বুফে মাধ্যমে। দাম নির্ধারণের বিষয়টিও অভিনব। বিভিন্ন আইটেম একটি বক্সে একসাথে করার পর বক্সটির ওজন করা হয়। তারপর প্রতি গ্রাম ৯৩ পয়সা ধরে ঠিক করা হয় বুফের আসল মূল্য। অল্প খরচে বেশি আইটেমের জায়গাগুলোতে আসলে অনেকেই পেটপূর্তি করে খেতে পারেন না। অল্প একটু খাওয়ার পরেই খাওয়ার শক্তি একদম ফুরিয়ে যায়। তাদের জন্য এই সালাদ লাভার্সটি সেরা জায়গা হতে পারে।
সালাদ নাম হলেও এখানে যে শুধু সালাদ আইটেম আছে তা নয়। ফ্রাইড রাইস থেকে শুরু করে গার্লিক মাশরুম, ভেজিটেবল, স্ফ্যাগেটি, চিকেন, পাস্তা; বলতে গেলে পূর্নাঙ্গ বুফের প্রায় সবি আছে। আর আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই বুফেটি নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যকর।
রয়াল ক্যুসিন, উত্তরা
উত্তরা রাজলক্ষীতে অবস্তিত এই ক্যুসিনটি নামের মতই রাজকীয়। বিভিন্ন উপলক্ষের দিনগুলোতে আলবত পাল্টে যায় পুরো রেস্টুরেন্টের চেহারা। অভিজাত ইন্টেরিয়র ঘুরে বেড়ানোর পর বুফে নেয়ার সময় এর দামটা চমকে দিতে পারে। ৮৫-এর বেশি আইটেমের বুফে লাঞ্চ ৭০০ টাকা এবং ৮৫-এর বেশি আইটেমের বুফে ডিনার ৮০০ টাকা। এমন প্রাসাদতূল্য জায়গার তুলনায় দামটা একটু কমই বলা যায়।
পড়ুন: রন্ধন পাঠশালা: ঢাকায় কোথায় রান্না শেখার কোর্স করতে পারবেন?
তাছাড়া তালিকায় বাহারি আইটেমের বাহুল্যের সাথে খুব বেশি পেটুকরাও পাল্লা দিতে পারবেন না। তবে চেখে দেখার সময় অতিথিরা টের পাবেন যে, মানের দিক থেকে এগুলোতে কোন কার্পণ্য করা হয়নি। অন্য সব ঐতিহ্যবাহী বুফে আইটেমের মধ্যে এখানে চোখে পড়বে দেশ-বিদেশের সালাদ, মাছসহ বিভিন্ন সবজি। রুফটপে খেতে খেতে প্লেনের উঠা নামা উপভোগ করার জন্যও রয়াল ক্যুসিন উপযুক্ত একটি জায়গা।
ফুডল্যান্ড ক্যাফে, ওয়ারী
পরিবারের ছোট-বড় সবাইকে নিয়ে দারুণ কিছু সময় কাটানোর জন্য এই রেস্টুরেন্টটি সেরা একটি নির্বাচন হতে পারে। মনোরম ইন্টেরিয়রের পাশাপাশি প্রতিটি আরামদায়ক বসার জায়গা অতিথিদের অনেকটা নিজের ঘরের মত অনুভূতি দেয়। আর এর সাথে যুক্ত হয় এদের সাশ্রয়ী মূল্যের বুফে। ৪০-এর অধিক আইটেমের জন্য লাঞ্চ বুফের খরচ ৬০০ টাকা, যা রাতের বেলা হয়ে যাবে ৭০০ টাকা।
আইটেমগুলোর মধ্যে ঘন থাই স্যুপটি আলাদাভাবে নজর কাড়বে। এছাড়া ফ্রাইড রাইস, চিকেন, চাইনিজ, সবজির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মিক্সড সালাদে পুরো খরচটা বেশ ভালো ভাবেই উশুল হবে। আর সাথে রঙ-বেরঙের মিষ্টান্ন তো আছেই।
পড়ুন: মধু কি সত্যি অমৃত?
আইরিশ স্কাই লাউঞ্জ, খিলগাঁও
খাবারের থেকে যারা আশেপাশের সৌন্দর্যটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তাদের জন্য এই রেস্টুরেন্টটি সঠিক জায়গা। রুফটপ রেস্টুরেন্ট হলেও খুব বেশি উপরে যে ঠিক তা নয়। চার তলায় অর্ধেক অংশ রুফটপ করে যথেষ্ট সুন্দর করে সাজানো হয়েছে খাবারের জায়গাটি। খিলগাঁওয়ের কেএফসি বিল্ডিং-এর সামনের এলাকাটি মোটামুটি একটু খোলামেলা হওয়ায় চার তলাতেই বেশ দারুণ স্কাই ভিউ পাওয়া যায়।
৪০-এর বেশি আইটেম সহ এদের বুফে প্যাকেজ ৫৬০ টাকা। সাথের পানীয়গুলোর জন্য অবশ্য আলাদা ভাবে খরচ করতে হয়। ফ্রাইড রাইস থেকে শুরু করে খাবারের শেষে মিষ্টান্ন সহ সবকিছুতেই পরিপূর্ণ বুফে। কিন্তু মানের দিক থেকে খাবারগুলো রেস্টুরেন্টটির সৌন্দর্য্যের সমকক্ষ হতে পারেনি। তাছাড়া এদের ফার্স্ট পেমেন্ট সিস্টেমটি নিয়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে বেশ মেলানো-মেশানো প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
শেষাংশ
ভোজন রসিক বাঙালির রেস্টুরেন্টমুখী হওয়ার সাথে সাথে বাড়ছে বাজেটের মধ্যে ঢাকার সেরা বুফে রেস্টুরেন্ট-এর সংখ্যাও। নান্দনিক ডিজাইন ও আরামদায়ক পরিবেশের কারণে কর্মজীবী মানুষদের প্রিয় জায়গায় পরিণত হচ্ছে ক্যাফেগুলো। এছাড়া সময়ের সাথে কর্মব্যস্ততা বৃদ্ধির গতি আরো দ্রুততর হওয়ায় রেস্তোরাগুলোর উপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে সাধারণত মানুষ। এরই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রসনা নির্ভর ব্যবসার প্রসার। বর্তমান যুগে রন্ধন শিল্প বেশ সম্মানজনক এবং চাহিদাসম্পন্ন পেশা হয়ে দাড়িয়েছে। তাই এ ধরনের খাবারের ব্যবসার প্রসিদ্ধি দেশ জুড়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নির্ণায়ক।
পড়ুন: অপরাজিতা ফুলের নীল চা: জাদুকরী স্বাস্থ্যগুণ, বানানোর পদ্ধতি