ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কয়রা এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির শিকার মানুষগুলো এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন নি। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের অভাবে দুর্ভোগ বাড়ছেই। ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগব্যাধি।
এছাড়া গবাদিপশুর একমাত্র খাদ্য খড় পানিতে পচন ধরেছে, আবার কোথায়ও জোয়ারের তোড়ে ভেসে গেছে। এ কারণে গবাদিপশুর খাদ্য নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয়রা। কেউ কেউ লোনা পানির ভিতর বন্দী অবস্থায় রয়েছেন, কেউ কেউ ঘরবাড়িসহ সর্বস্ব হারিয়ে অন্যত্র অবস্থান করছেন। বিশেষ করে মাছের ঘের, খামার, উঠতি ফসল, ব্যবসা হারিয়ে তারা কঠিন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ফলে অনেকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করে টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি জানাচ্ছেন।
গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া এলাকায় কপোতাক্ষ নদের ভেঙে যাওয়া বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত দেখতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা) আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আক্তারুজ্জামান বাবু।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়রা পাউবোর ১৩/১৪-১ ও ১৩/১৪-২ নম্বর পোল্ডারের (চারদিকে নদীবেষ্টিত দ্বীপ অঞ্চল) অন্তর্ভুক্ত। এর পূর্ব পাশে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী, দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে কপোতাক্ষ ও উত্তর পাশে রয়েছে কয়রা নদী। উপজেলা খুলনার হলেও এলাকাটি পাউবোর সাতক্ষীরার অন্তর্ভুক্ত। ২৬ মে (বুধবার) ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কয়রা, কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর পানি জোয়ারে ৬ থেকে ৭ ফুট বৃদ্ধি পায়। এতে উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১১টি স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে এবং উপচে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়। বাড়িঘরে জোয়ারের পানি ঢোকায় ২৫ হাজারের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের শাকবাড়িয়া নদীর গাতিরঘেরী বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া কুলসুম বেগম বলেন, ‘ভালো কুরি (করে) বাঁধ মেরামত না করায় এট্টু (একটু) জোয়ার হুলিই (হলেই) আমরা ডুবি। ঘর ছাইরে (ছেড়ে) বাঁধে আইসে (এসে) উঠি। আমাগে খাবার নেই। লবণ পানি খাতি (খেতে) পারি না। শরীল (শরীর) গতর ভালো না। কষ্টে মানসির (মানুষের) মুখ হাড়ির তোলা (হাড়ির তলা) কুরি (করে) রাখছে’।
তিনি বলেন, 'গাঙ বাড়ে (নদীর পাড়ে) যাগে (যাদের) বাড়ি সুন্দিবেলা (সন্ধ্যাবেলা) হলেই তাগে (তাদের) ছাবাল (ছেলে) ম্যাইয়ে (মেয়ে) লইয়ে (নিয়ে) চিন্তায় পড়ে যায়। জোয়ারে হুলি যদি আবারও ডুইবে যায়।'
দুই নম্বর বাগালী ইউনিয়নের বামিয়া গ্রামের কলেজছাত্র আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের বলেন, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ওষুধের অভাবে গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছেই। বাঁধ ভেঙে এ ইউনিয়েনের গ্রামগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। অধিকাংশ এলাকা থেকে জোয়ারের পানি নেমে গেলেও অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলোতে এখনও হাঁটুপানি রয়েছে। তবে, পানিবন্দি এলাকাগুলোতে নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে মারাত্মকভাবে। চরম খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নিম্নআয়ের লোকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে মারাত্মক বিপাকে পড়েছেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, গ্রামের কেউ এখনও কোনো সরকারিভাবে ত্রাণ পায়নি। কিছু এনজিও বিশুদ্ধ পানি দিয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার নাজমুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের এখানে দুই জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙেছিল। এক জায়গায় রিংবাঁধ হয়ে গেছে। এক জায়গায় হয়নি। শাকবাড়িয়া নদীর গাতিরঘেরী বাঁধের ভাঙন এখনও ঠিক হয়নি। আংটিহারা বেড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে গ্রামবাসী ঠিক করেছেন। আমাদের ইউনিয়নের প্রায় ৩০০ পরিবার মানুষ ওয়াপদার বেড়িবাঁধে রয়েছে। কয়েকটি পরিবার সাইক্লোন সেন্টারে রয়েছে। এলাকার মানুষ ত্রাণ নয় টেকসই বেড়িবাঁধ চাই।'
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: খুলনা উপকূলে ৬০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি
গোবিন্দপুর আব্দুল জব্বার মাধ্যমিক বিদ্যালয় সাইক্লোন সেন্টারে থাকা ইকবাল বলেন, মিষ্টি পানি ও খাবারের অভাব রয়েছে। অনেকবার দাবি করার পর মেডিকেল টিম এখন নিয়মিত আসছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, মহারাজপুর, বাগালী ও উত্তর বেদকাশী তিনটা ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামে এখনও পানি রয়েছে। সবাই পানিবন্দি রয়েছেন। প্রত্যেক ইউনিয়নে দুই-আড়াই টন চাল দেওয়া হয়েছে। নগদ টাকা ও শুকনা খাবারের প্যাকেট দেয়া হয়েছে। আরও ৫টন চাল এসেছে নগদ টাকাও এসেছে। যা পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে।
বাঁধ মেরামত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কয়রায় ১২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ প্রকল্প একসঙ্গে তো বাস্তবায়ন হবে না। কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। কিছু চলমান রয়েছে। এছাড়া কিছু প্রকল্প প্রস্তাবিত রয়েছে।