আজকে ইতালির চোখে জল, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ! কাঁদছে ইতালি, কাঁদছি আমরা। করোনা ভাইরাসের আগ্রাসনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে পুরো ইতালি। গোটা ইতালি জুড়ে চলছে চাপা আতঙ্ক। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত গোটা ইতালির জনজীবন।
প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে শত শত তাজা প্রাণ। আর আক্রান্তের সংখ্যাতো বাড়ছে লাগামহীন ভাবে। সারা ইতালিকে রেড জোনের আওতায় এনেও ঠেকানো যাচ্ছেনা নতুন আক্রান্তের সংখ্যা। এদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে বিশ্ব মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে। সব দিক বিবেচনায় আমরা ইতালিবাসী অজানা এক গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছি। একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি আমরা। তবে আমরা বাঙালি কমিউনিটি এখন পর্যন্ত সবাই ভালো আছি, সুস্থ আছি। তবে বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া আমাদের বাংলাদেশিদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে ইতালি সরকার কোভিড-১৯ রোধে তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী গত ১০ মার্চ রাতে সারা ইতালিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। দেশের সব নাগরিককে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ফার্মেসি, সুপারমার্কেট ব্যাংকসহ মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া ইতালির সমস্ত বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া যাবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের নির্ধারিত একটি ফরম পূরণ করে সাথে রাখতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে ২০৬ ইউরো জরিমানা এবং ৩ মাসের কারাদণ্ড। তবে সবাইকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের না হওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এদিন তাঁর বক্তব্যে পুরো ইতালি লকডাউন করার ঘোষণা দেয়ার সময় অনেকটা আবেগময় হয়ে পড়েন। এসময় সবকিছু বন্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা আজকে দূরত্ব বজায় রাখবো, কালকে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য। আজকে থেমে থাকবো আগামীতে দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যাবার জন্য। তার এই বক্তব্যটির মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে সাহস এবং উৎসাহ দেয়া। সাথে সাথে সবাই যেন নিজ নিজ বাসস্থানে অবস্থান করে।
আমরা বাঙালি কমিউনিটি নেতাবৃন্দ বারবারই বলছি আসুন আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করি। আতংকিত না হয়ে সর্তক হই, সচেতন হই। বিশেষ করে অহেতুক চলাফেরা না করি। প্রত্যেকে নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করি। আর এখন যেহেতু বাইরে বের হলে জরিমানা গুণতে হয় তাই বর্তমানে জনগণ অনেকটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বাসায়ই অবস্থান করছে। ফলে বাসায় অনেকটা বন্দি জীবন যাপন করছেন ইতালির মানুষজন। অনেকটা ভূতড়ে গলির মতো ইতালির রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়েছে।
তবে একটি কথা না বললেই নয়, এতোদিন বলেছি সবাইকে আতঙ্কিত না হতে। কিন্তু এখন বলছি আমি এবং আমরা আতঙ্কিত। আর এই আতঙ্কের কারণে যদি সচেতনতা বাড়ে তাহলে ক্ষতি কি! মোদ্দাকথা কোরোনাভাইরাস থেকে রক্ষাপেতে সচেতনতাই জরুরি। সচেতন হোন, নিজে বাচুঁন, অন্যকে বাঁচান।
এদিকে ইতালিতে এ পর্যন্ত (১৮ মার্চ) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার। মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে। একদিনে (১৮ মার্চ) সর্বোচ্চ ৪৭৫ জন মারা গেছেন। সুস্থ হয়েছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ।
এদিকে আমরা যারা ইতালি প্রবাসী আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। সরকার প্রত্যেকের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বাঙালি কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ বারবারই বলে আসছি আমরা যেন কেউ ইতালী ত্যাগ না করি। কারন এখানে আমরা ভালো আছি, সুস্থ আছি। সব দিয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা রয়েছে। কোনো কিছুরই সংকট নেই।
সুপারশপগুলো খোলা রয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে পর্যাপ্ত মালামাল মজুদ রয়েছে, কেউ যেন আতংকিত না হই। সাথে সাথে নাগরিকদের জীবনযাত্রার দিকে সরকার বিশেষ নজর রেখেছে। আর তারই আওতায় ইতালি সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা ঘোষণা করেছে।
এরমধ্যে সবচেয়ে বড় আকারে ১৬ মার্চ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ইতালির প্রত্যেক জনগণের অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ৩৫০ বিলিয়ন ইউরোর একটি বিশেষ বিল পাস করেছে। এই বিলে ব্যাক লোন নিয়ে যারা বাসা ক্রয় করেছেন তারা বাসার কিস্তি ১৮ মাস বন্ধ রাখতে পারবে।
- গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে আগামী ২ মাস কোন মালিকের কর্মচারী ছাঁটাই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই কারো কাজ হারানোর চিন্তা থাকবে না ।
⁃ ব্যক্তিগত লোন এর কিস্তি শর্ত সাপেক্ষে বন্ধ রাখা যাবে।
⁃ মালিক বেতন দিতে সামর্থ্য না হলে মিনিমাম ১ জন কর্মচারী থাকলেও মালিক পক্ষ cassa integrazione guadagniএর আবেদন করতে পারবে, এতে ৮০% বেতন সরকার পরিশোধ করবে।
⁃ ফ্যামিলি বোনাস দিবে।
⁃ যাদের ব্যবসা আছে বাৎসরিক আয় [redditi] ৫০ হাজারের নিচে তারা মাসে ৬০০ ইউরো করে পাবে।
⁃ এছাড়া করোনা ভাইরাস বিপর্যয় পরবর্তী মাসে বেতনের সাথে অতিরিক্ত ১০০ ইউরো করোনার জন্য যোগ হবে।
⁃ এমন আরও বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে।
এদিকে ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রী লুইজি দি মাইয়ো আহ্বান করেছেন, আমরা যারা ইতালিতে বসবাস করছি সবাই এই মুহুর্তে খাবার-দাবার বা অন্য কোন জিনিসপত্র ক্রয় করলে অবশ্যই আমরা Made in Italy (অর্থাৎ ইতালিয়ান তৈরিকৃত) দেখে ক্রয় করবো। এতে এই দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য হবে।
অন্যদিকে ইতালির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সিলবিয়ো বেরলুসকোনি মিলান লোম্বার্দিয়া এলাকায় করোনা মোকাবিলায় ১০ মিলিয়ন ইউরো (এক কোটি ইউরো) দান করেছেন।
তবে এই মূহর্তে সবচেয়ে বড় কথা আসুন আমরা সবাই সচেতন হই, নিজেরা সুস্থ থাকি, অন্যদেরকে সুস্থ রাখি। দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন সবাইকে হেফাজত করে।
লেখক: এস.টি শাহাদাৎ (শাহাদাৎ হোসেন), ভেনিসের ব্যবসায়ী।
আরও পড়ুন: স্পেনের অবরুদ্ধ শহরে আশার গল্প