শুনতে অস্বাভাবিক মনে হলেও নগর প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে গত তিন ম্যাচের একটিতেও জয় পায়নি বার্সেলোনা। এর মধ্যে সবশেষ দুটি ম্যাচেই তারা হেরেছে ৪-২ ব্যবধানে। তবে বড় ব্যবধানে জিতে সেই হারের ক্ষতে প্রলেপ দিল হান্সি ফ্লিকের শিষ্যরা।

কাতালুনিয়ার এস্তাদি মন্তিলিভিতে রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় বিকালে গত মৌসুমে অসাধারণ পারফর্ম করে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা করে নেওয়া জিরোনার বিপক্ষে ৪-১ গোলের জয় পেয়েছে বার্সেলোনা।

গত মৌসুমে এই স্টেডিয়ামেই নগর প্রতিদ্বন্দ্বীদের ৪-২ ব্যবধানে হারিয়ে ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার গৌরব অর্জন করে কোচ মিচেলের শিষ্যরা। ২০২৩ সালের ২৮ জানুয়ারির পর থেকে এই মাঠে জয়বঞ্চিত ছিল বার্সেলোনা। ওই ম্যাচে পেদ্রির একমাত্র গোলে তিন পয়েন্ট সংগ্রহ করেছিল ‘ব্লাউগ্রানা’ খ্যাত দলটি।

তবে আজকে জোড়া গোল করে ম্যাচের নায়ক লামিন ইয়ামাল। এছাড়া একটি করে গোল করেন গত দলবদলের মৌসুমে বার্সায় ফেরা মিডফিল্ডার দানি অলমো এবং চোটের কারণে দীর্ঘদিন পর মাঠে ফেরা পেদ্রি। এছাড়া জিরোনার একমাত্র গোলটি করেন ক্রিস্তিয়ান স্তুয়ানি।

এদিন দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা চ্যালেঞ্জ জানালেও ম্যাচজুড়ে আধিপত্য ধরে রাখে বার্সেলোনা। ম্যাচজুড়ে ১৭টি শট নেয় তারা যার আটটি লক্ষ্যে ছিল। অন্যদিকে, ৯টি শটের পাঁচটি লক্ষ্যে রেখেও একটির বেশি গোল পায়নি স্বাগতিকরা।

আরও পড়ুন: বার্সার দায়িত্ব নিয়ে শিরোপা জিততে বদ্ধপরিকর ফ্লিক

ম্যাচের শুরু থেকেই জিরোনাকে চেপে ধরে বার্সেলোনা। এর ফল তারা পেয়ে যাচ্ছিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।

ষষ্ঠ মিনিটে ক্ষিপ্র আক্রমণে উঠে প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে একের পর এক পাসের পর জোরালো শট নেন একপ্রকার ফাঁকায় থাকা লামিন ইয়ামাল, কিন্তু ওই শটে জিরোনা গোলরক্ষক পাওলো গাস্সানিগাকে তেমন কোনো পরীক্ষাতেই ফেলতে পারেননি ১৭ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার। ফলে ম্যাচে এগিয়ে যাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় বার্সা।

ম্যাচের ষোড়শ মিনিটে কর্নার থেকে আসা ক্রসে হেডারে লক্ষ্যভেদ করার চেষ্টা করেন লেভানডোভস্কি, তবে বল সরাসরি গোলরক্ষকের কাছে চলে যায়। পরের মিনিটে জিরোনার মিগেল গুতিয়েরেসের নিচু শট ঠেকান বার্সা গোলরক্ষক মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন।

ম্যাচের ২৩তম মিনিটে বাঁ পাশ ধরে এগিয়ে গিয়ে বক্সে ঢুকেই বুলেট গতিতে শট হানেন বার্সা উইং ব্যাক আলেহান্দ্রো (আলেক্স) বালদে, কিন্তু তার সেই শট ক্রসবারের বেশ বাইরে দিয়ে চলে যায়।

তবে ম্যাচের আধঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর বার্সেলোনাকে আর আটকে রাখতে পারেনি স্বাগতিকরা।

৩০তম মিনিটে গোলরক্ষকের ছোট পাস ধরে সামনে এগোচ্ছিলেন জিরোনা ডিফেন্ডার দাভিদ লোপেস। বক্সের বাইরে বের হতেই হঠাৎ ছুটে গিয়ে তার কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নেন লামিন। এরপর মাঝ বরাবর একটু এগিয়ে গিয়ে জোরালো শটে বল ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন তিনি।

৩৭তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিতীয় গোলে দ্বিগুণ করেন লামিন। বাঁ পাশে বক্সের বেশ বাইরে ফ্রি কিক আদায় করেন রাফিনিয়া। সেখান থেকে তিনি বক্সের মধ্যে ক্রস দিলে জটলার মধ্যে লেভানডোভস্কির পায়ে লেগে বল কিছুটা পেছনে চলে আসে। ফাঁকায় থাকা লামিন দৌঁড়ে গিয়েই বাঁকানো শটে লক্ষ্যভেদ করেন।

এর ফলে লিগে এখন পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচে তিন গোল ও চার অ্যাসিস্টে মোট ৭ গোলে অবদান রাখলেন ১৭ বছর বয়সেই ব্যালন দ’রের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা করে নেওয়া এই তরুণ।

৪৪তম মিনিটে নিশ্চিত গোলের সুযোগবঞ্চিত হয় গত দলবদলে টটেনহ্যাম থেকে জিরোনায় আসা ব্রায়ানস হিল। এর কিছুক্ষণ পরই জিরোনাকে পেনাল্টি দিয়ে বসেন বার্সা ডিফেন্ডার ইনিগো মার্তিনেস। তবে ভিএআর রিভিউয়ের পর অন-ফিল্ড মনিটর দেখে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন রেফারি। ফলে হতাশ হয় জিরোনা সমর্থকরা।

আরও পড়ুন: ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতে বার্সার ‘ফ্লিক অধ্যায়’ শুরু

রিভিউতে দেখা যায়, বক্সে মধ্যে আসা ক্রস হেডারে ক্লিয়ার করতে লাফিয়ে ওঠেন মার্তিনেস ও বালদে, তাতে সফল হন পেছনে থাকা বালদে। তিনি হেড দিলে মার্তিনেসের উপরে থাকা হাতে লাগে বল।

পিচ সাইড ব্যাখ্যায় বলা হয়, লাফিয়ে ওঠার সময় হাত স্বাভাবিকভাবেই উপরে থাকায় এবং পেছন থেকে বল তার হাতে লাগায় রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বাতিল করেন।

এর ফলে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেই বিরতি যায় বার্সেলোনা।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই তৃতীয় গোল পেয়ে যায় বার্সেলোনা। ৪৭তম মিনিটে মাঝমাঠের লাইনের ওপর থেকে দানি অলমোর দৌড় লক্ষ্য করে তার উদ্দেশে শূন্যে বল ভাসিয়ে দেন জুল কুন্দে। বল ধরে ডান পাশ দিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি। এরপর একেবারে গোললাইনের কাছ থেকে প্রতিপক্ষের এক ডিফেন্ডারের চ্যালেঞ্জ সামলে দুরূহ কোণ দিয়ে ঠিকানা খুঁজে নেন এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।

লাইপসিগ থেকে ৬০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে তাকে কাতালুনিয়ায় নিয়ে আসার প্রতিদান শুরু থেকেই দিতে শুরু করেছেন অলমো। বার্সেলোনার জার্সিতে তিন ম্যাচে মাঠে নেমেই তার সবকটিতেই জালের দেখা পেয়েছেন তিনি। 

আরও পড়ুন: অভিষেক ম্যাচে গোল করে বার্সেলোনাকে জেতালেন অলমো

৫৬তম মিনিটে একক প্রচেষ্টায় দারুণ একটি গোলের সুযোগ তৈরি করেন লেভানডোভস্কি। প্রতিপক্ষের একাধিক ডিফেন্ডারের চ্যালেঞ্জ সামলে একেবারে গোলমুখে চলে যান তিনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। দুই মিনিট পরই লামিনের বাঁকানো শট ঝাঁপিয়ে প্রতিহত করেন জিরোনা গোলরক্ষক। তার দুই মিনিট পর লেভানডোভস্কির আরেকটি শট পোস্টের উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

৬৪তম মিনিটে চতুর্থ গোলটি করে দলের জয় নিশ্চিত করেন পেদ্রি। খানিকটা দূর দিয়ে পেদ্রিকে বক্সে ঢুকতে দেখে জিরোনার বক্সের সামনে থেকে ডিফেন্সচেরা পাস দেন তরুণ মিডফিল্ডার মার্ক কাসাদো। বল ধরে প্রতিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারকে ড্রিবল করে গোলরক্ষককেও পরাস্ত করেন এই প্রতিভাবান মিডফিল্ডার।

৮০তম মিনিটে একটি গোল পরিশোধ করে সমর্থকদের উদযাপনের উপলক্ষ এনে দেয় জিরোনা। সতীর্থের জোরালো পাস ধরতে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যান ক্রিস্তিয়ান পোর্তু। এসময় টের স্টেগেন এগিয়ে এলে তাকে পরাস্ত করে ডান পাশ দিয়ে বক্সে ঢুকে গোলমুখে পাস বাড়ান তিনি। সেখান থেকে প্রথম ছোঁয়াতেই লক্ষ্যভেদ করেন ক্রিস্তিয়ান স্তুয়ানি।

দুই মিনিট পর ফের আক্রমণে ওঠে বার্সেলোনা। তবে বক্সের বাইরে থেকে পাউ ভিক্তরের বাঁকানো শট ক্রসবারের কোনা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বাইরে বেরিয়ে যায়।

আরও পড়ুন: রাফিনিয়ার হ্যাটট্রিক, ৭-০ ব্যবধানে জিতল বার্সেলোনা

ম্যাচের ৮৬তম মিনিটে বাজে ফাউল করে সরাসরি লাল কার্ড দেখেন ৬৯তম মিনিটে লেভানডোভস্কির বদলি নামা ফরোয়ার্ড ফেররান তোরেস।

জিরোনার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার  ইয়াসের আসপ্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে তার পায়ের ওপর পাড়া দিয়ে বসেন ফেররান। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে ফাউলের বাঁশি বাজান। রিভিউতেও শাস্তি বহাল থাকলে বাকি সময়ের জন্যে দশজনের দলে পরিণত হয় বার্সেলোনা।

এর ফলে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর শক্ত প্রতিপক্ষ ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচে এই স্ট্রাইকারকে পাবেন না হান্সি ফ্লিক।

অতিরিক্ত সময়ে একা একা আক্রমণে উঠে ফাঁকায় পাওয়া গোলরক্ষককে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হন ভিক্তর। ফলে আরও একটি গোল থেকে বঞ্চিত হয় সফরকারীরা।

এরপর আর তেমন কোনো সুযোগ তৈরি না হওয়ায় ৪-১ ব্যবধান ধরে রেখে মাঠ ছাড়ে বার্সেলোনা।

এই জয়ে লিগের প্রথম পাঁচ ম্যাচের সবগুলো জিতে উড়ন্ত শুরু অব্যাহত রাখল কাতালান জায়ান্টরা। সেইসঙ্গে বার্সেলোনার দায়িত্ব নিয়ে এখনও অপরাজিত কোচ হান্সি ফ্লিক। লিগে পাঁচ ম্যাচে ১৭টি গোল করেছে তার দল, হজম করেছে মাত্র ৪টি গোল। পূর্ণ ১৫ পয়েন্ট নিয়ে তাই টেবিলের শীর্ষেই রইল বার্সেলোনা।

আরও পড়ুন: চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্র: আবারও বায়ার্নের সামনে বার্সা, লিভারপুলকে পেল রিয়াল

পঞ্চম রাউন্ডের খেলা শেষে তিনটি জয় ও দুটি ড্রয়ে ১১ পয়েন্ট নিয়ে বার্সেলোনার পরই রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। গতরাতে দুটি পেনাল্টির কল্যাণে রিয়াল সোসিয়েদাদের মাঠে ২-০ গোলের জয় পেয়েছে কার্লো আনচেলত্তির দল।

এছাড়া তিনটি জয় ও দুটি ড্রয়ে রিয়াল মাদ্রিদের সমান ১১ পয়েন্ট নিয়েও গোল ব্যবধানে পিছিয়ে থাকায় তৃতীয় স্থানে ভিয়ারিয়াল। তিনটি জয়ে ৯ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের চতুর্থ স্থানে গত কয়েক মৌসুম ধরে ভুগতে থাকা সেল্তা ভিগো।

এক ম্যাচ কম খেলে ৮ পয়েন্ট নিয়ে আতলেতিকো মাদ্রিদের অবস্থান পঞ্চম। রাতে টেবিলের তলানির দল ভালেন্সিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামবে দিয়েগো সিমিওনের শিষ্যরা। ম্যাচটি ৩ গোলের ব্যবধানে জিতে ভিয়ারিয়াল ও রিয়াল মাদ্রিদের সমান ১১ পয়েন্ট নিয়েও দ্বিতীয় স্থানে ওঠার সুযোগ থাকবে দলটির।