৫০ বছর আগে এই দিনে (৪ ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে এই ঐতিহাসিক বার্ষিকীতে আমি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে ব্রিট বাংলা বন্ধনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা উপলক্ষে অভিনন্দন জানাই।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে আমি গর্বিত যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে যুক্তরাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার আগে, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে তার ঐতিহাসিক সফরে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে একটি নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন যা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রাপ্তি ত্বরান্বিত করে। এই ঐতিহাসিক সফর অন্যান্য কমনওয়েলথ দেশগুলোকে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করেছে। এর সাথে আমি স্মরণ করছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে, যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একটি উদীয়মান বাংলাদেশে জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের মানবিক সহযোগিতার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের জন্য যুক্তরাজ্যে জনসমর্থনের প্রতিফলন আমাদের সরকারের এই সহযোগিতা। এই সবই যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি অনন্য ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে একটি ব্রিটিশ হাইকমিশন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস-হোম বাংলাদেশ সফর করেন। তখন থেকেই যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের গবেষণা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক উন্নয়ন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার উন্নতি, নারী ও শিশুদের আয়ু বৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অংশীদার। এই সবই গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিতে সাহায্য করেছে।
৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে এগিয়ে যেতে থাকলে যুক্তরাজ্য তার দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতায় বৈচিত্র্য আনতে শুরু করে। সেই সময়ে আমরা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছি। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্য সাভারে একটি মিলিটারি স্টাফ কলেজ স্থাপনে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছিল। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালাগান প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করেন। এই গত পাঁচ দশকে অনেক বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে তাঁদের বসতি স্থাপন করেছে। বর্তমানে প্রায় ছয় লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ যুক্তরাজ্যে বসবাস করে। গত পাঁচ দশকে ব্রিটিশ ও বাংলাদেশি জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক গভীর ও শক্তিশালী হয়েছে।
আরও পড়ুন: ভ্রমণকারীদের জন্য করোনার বিধিনিষেধে পরিবর্তন আনছে যুক্তরাজ্য
আমি শ্রদ্ধার সাথে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সফর স্মরণ করছি। সেই সফরে তিনি ঢাকা থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণে একটি আদর্শ গ্রাম পরিদর্শনের জন্য বাংলাদেশের ট্রেনে ভ্রমণ করেছিলেন। এর পর গত কয়েক দশকে, মহামান্য প্রিন্স অফ ওয়ালেস, প্রিন্সেস রয়েল, প্রধানমন্ত্রী জন মেজর, টনি ব্লেয়ায় এবং ডেভিড ক্যামেরুন একটি উদীয়মান জাতি প্রত্যক্ষ করতে বাংলাদেশ সফরে আসেন। এই পুরোটা সময় জুড়ে দারিদ্র, বন্যা ও ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও যুক্তযাজ্য একসাথে কাজ করেছে এবং এর মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুগভীর হয়েছে। একটি স্বাধীন ও সংবেদনশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে এবং ইতিবাচক রূপান্তরের আদর্শ হিসেবে সামনে এগিয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের ‘বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ’ থেকে ‘বিশ্বের দ্রুততম বিকাশমান অর্থনীতি’ হয়ে ওঠার অগ্রযাত্রা এবং সেই যাত্রায় যুক্তরাজ্যের অবদান নিয়ে আমি অত্যন্ত গর্বিত। স্বাধীনতার প্রথম অর্ধ-শতকে বাংলাদেশ যে পরিচয় অর্জন করেছে তার জন্য বাংলাদেশ সমগ্র পৃথিবীর কাছে সমাদৃত। বাংলাদেশ এখন তৈরি পোশাক শিল্পের প্রাণকেন্দ্র, জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তি ও সুরক্ষায় অন্যতম অবদানকারী, এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অন্যতম প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর। এই অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পেরে যুক্তরাজ্য আনন্দিত।
আরও পড়ুন: ব্যাটনের আগমন বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক: ডিকসন
বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যেকার আধুনিক যোগসূত্রের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায়, শিক্ষা, উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রিকেট এবং রন্ধন শিল্পে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক বন্ধনের ভিত্তিতে একুশ শতকের আধুনিক অংশীদারিত্ব গঠনের বিষয়ে আমাদের লক্ষ্য অভিন্ন।
আগামী অর্ধ-শতক এবং অনাগত ভবিষ্যতে এই দুই দেশের মানুষের মৈত্রী ও সংস্কৃতির বন্ধন আরও সুসংহত হবে সেই কামনা করছি। ব্রিট বাংলা বন্ধন!